সংবাদ
৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৭
কারাগার অভ্যন্তরে শেখ মুজিবের মামলার শুনানী
(আদালত বার্তা পরিবেশক)
গতকাল ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আফসার উদ্দিনের কোর্টে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী দণ্ডবিধির ৩৪২ ধারা মােতাবেক আনীত মামলার শুনানী শুরু হইয়াছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, গত বৎসরের ২০শে মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় রাষ্ট্রের পক্ষে হানিকর বক্তৃতা প্রদানের অভিযােগে রমনা পুলিস উক্ত মামলা দায়ের করে।
গতকল্য শেখ মুজিবর রহমান সবিনয়ে নিবেদন করেন যে, রাষ্ট্রের পক্ষে হানিকর কিংবা জনসাধারণের মধ্যে সরকার বিরােধী উত্তেজনা বা অসন্তোষ সৃষ্টি করিতে পারে কখনাে তিনি অনুরূপ কোন উক্তি করেন নাই। তিনি সর্বদাই সরকারী নীতির সুষ্ঠু, সমালােচনা এবং দেশের সংহতি জোরদার করার পরামর্শ দিয়াছেন। দেশের উভয়াংশে জনসাধারণের মধ্যে ঘৃণা ও অসন্তোষ সৃষ্টির অভিযােগ তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অস্বীকার করিয়া বলেন যে, সর্বদাই তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়িয়া তােলার অনুকূলে কাজ রহিয়াছেন।
শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, তাহার বক্তৃতার সম্পূর্ণ অংশ লেখা হয় নাই এবং অনেক স্থলে ভুল লেখা হইয়াছে। এবং এজন্য ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হইয়াছে।
তিনি নিবেদন করেন যে, যদি ভালভাবে লেখা হইত তাহা হইলে দেখা যাইত যে, সরকারকে একটি বাস্তবপন্থা অবলম্বন করিবার জন্য পরামর্শ দেওয়া হইয়াছে, যাহাতে সত্যিকারের জাতীয় সংহতি ও দেশের উভয় অংশের রক্ষাব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়। তিনি আরও বলেন যে, যখন তিনি ‘সংগ্রামের কথা বলেন তখন নিয়মতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বুঝান। সর্বশেষে তিনি নিজেকে নির্দোষ বলিয়া দাবী করেন।
বিবাদীপক্ষে মামলায় উপস্থিত ছিলেন এডভােকেট জনাব এ, সালাম খান, জনাব এফ, এ, রব, জনাব আবুল হােসেন ও এম, এস, জোহা চৌধুরী এবং বাদীপক্ষে উপস্থিত ছিলেন, ডি,এস,পি জনাব আবদুল খালেক। শেখ মজিবের বিরুদ্ধে দেশরক্ষা বিধির ৪৭ নং ধারাবলে প্রণীত চার্জশীটে ২০শে মার্চ তারিখের (১৯৬৬) জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতার ‘নিম্নোক্ত অংশসমূহকে আপত্তিকর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।
১। … আঠার বৎসর মানুষকে শােষণ করেছে সেই শােষকের দল বেড়িয়ে পড়ছে।
২। … আঠার বৎসর পর্যন্ত সরকার সর্বস্ব লুট করছে…।
৩। … কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত ক্ষমতা থাকা সত্বেও পূর্ব পাকিস্তানকে একমাত্র আল্লা রক্ষা করেছেন।
৪। … পূর্ব বাংলায় কয়খানা ভাঙ্গা প্লেন ছিল। আমি জানি। যাহা ছিল তাহা শুনলে দিশেহারা হবেন। বাংলাদেশে এক ডিভিশন সৈন্য ছিল। আমি বলি সামান্য কয়খানা প্লেন ছিল।
৫। … আপনাদের কাছে আঠার বৎসর পর্যন্ত হিসাব-নিকাশের পাতা দেওয়া হইয়াছে, আপনারা আমাদের দিকে দেখেন নাই …।
৬। … পূর্ব পাকিস্তানে সােনা ১৫০ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে সােনা ১২০ টাকা। এতে আবার কাষ্টমস হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে যে জিনিসের দাম ৫ টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে ২ টাকা। পূর্ব পাকিস্তানে বড় বড় শিল্প-কারখানার মালিক হয়েছেন যারা তাঁর আয় করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যান ….।
৭। .. রাজধানী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, মূলধন পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে … আপনারা সব বাজার। আমরা বাজার হতে চাই না, পাকিস্তানের নাগরিক হইতে চাই। … জারী করে একটা … দিয়াছেন। বাংলা কোথায় আছে?
৮।… তুমি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও আমাদের … দুর্দিনে আমাদের পাশে দাঁড়াতে পার নাই….।
৯। … আপনাদের কাছে আবেদন করব-আমাদের উপর অত্যাচার হচ্ছে।
পূর্ব বাংলায় বিড়ির পাতা আনতে পারবে না, পশ্চিম পাকিস্তানে আনতে পারবে। আমরা নাকি… সেইখান থেকে সােনা আনতে পারব না; কিন্তু যুদ্ধের সময়… এ ৪০ হাজার বস্তা গম পাওয়া গেল। আরব সাগরে সােনা পাওয়া গেল।
১০। … বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে …..।
১১। …… আমি জানি আইয়ুব খান সাহেব বলেছেন, আমাদের সমূলে ধ্বংস করে দিবেন, আমাদের উপর অত্যাচার করবেন……।
১২। … তাই ভাইয়েরা আপনারা ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান এবং সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
১৩। … মিথ্যাচারের অবসান করতে হবে। মানুষকে মুক্তি দিতে হবে…।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব