You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংবাদ
২৬শে অক্টোবর ১৯৬৬

শেখ মুজিবের মামলার রায়ের বিশদ বিবরণ

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে পরিচালিত আদালতে ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব এম, এ, মালেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযােগ হইতে বেকসুর খালাস দিয়াছেন। ম্যাজিষ্ট্রেট তাহার রায়ে এই মন্তব্য করেন যে, সভায় হাজার হাজার বাংলা ভাষাভাষী লােক যােগদান করা সত্ত্বেও বাদীপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে সমস্ত বাংলা জানা লােককে এড়াইয়া কেন গুটি কয়েক অবাঙ্গালীকে অভিযােগ প্রমাণের জন্য সাক্ষী হিসাবে হাজির করিয়াছেন, তাহা তাহার বােধগম্য হয় না। ম্যাজিষ্ট্রেট বাদীপক্ষের সাক্ষী বাছাই-এর কাজটাকে হাস্যকর বলিয়া অভিহিত করেন।
ম্যাজিষ্ট্রেট তাঁহার রায়ে বলেন, বাংলা ভাষা যাহাদের নিকট গ্রীক ভাষার সমতুল্য এমন কতিপয় অবাঙ্গালীকে বাদীপক্ষ সাক্ষী হিসাবে দাঁড় করিয়াছেন। মােহাম্মদ ইসমাইল অনুরূপ একজন সাক্ষী। বাংলা ভাষায় তাহার সাধারণ জ্ঞানও নাই। আলােচ্য জনসভায় আসামী বলিয়া কথিত কতিপয় বাংলা শব্দ বলার জন্য তাঁহাকে শিখাইয়া দেওয়া হইয়াছে। শেখানাে হইলেও সাক্ষী বাদীপক্ষের ভাষ্য মত বক্তৃতাটা উদ্ধৃত করতে সমর্থ হয় নাই।
ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব মালেক বলেন, সৈয়দ হায়াত আজিজ আর একজন অবাঙ্গালী সাক্ষী। তাহাকেও কথিত বক্তৃতার কতিপয় অংশ বিবৃত করার বিষয় শিখান হয় বলিয়া প্রতীয়মান হয়; কিন্তু এই সাক্ষীও মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হইয়াছে। কারণ সে আসামীপক্ষের উকিলের বাংলায় জিজ্ঞাসিত কোন প্রশ্ন বুঝিতে পারেন নাই। ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব মালেক বলেন, সরকারপক্ষের অন্যতম সাক্ষী ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আফসার উদ্দিন আহমদ নিঃসন্দেহে একজন শিক্ষিত বাঙ্গালী। তিনি আলােচ্য বক্তৃতার কোন অংশই স্মরণ করিতে পারেন নাই। দীর্ঘদিন পর আলােচ্য বক্তৃতার কোন অংশ স্মরণ না থাকাই সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হইল তাহার মত শিক্ষিত বাঙ্গালীর পক্ষে বক্তৃতার কোন অংশ স্মরণ রাখা যেখানে সম্ভব হয় নাই, সেক্ষেত্রে অন্যান্য অবাঙ্গালী সাক্ষীর পক্ষে এত দীর্ঘদিন পরও দীর্ঘ বক্তৃতা স্মরণ রাখা কি করিয়া সম্ভব।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, ১৯৬৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর সকল বিরােধী দলের উদ্যোগে প্রতিরােধ দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানে আয়ােজিত এক জনসভায় রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তৃতাদানের জন্য শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রমনা পুলিশ গত ১৯৬৪ সালের ১১ই নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনের ৭(৩) ধারা অনুযায়ী এক মামলা দায়ের করেন।
উক্ত মামলায় বাদীপক্ষে দুইজন তদন্তকারী পুলিশ অফিসার ও একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটসহ মােট ৭ জন সরকারী সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। তাঁহারা প্রত্যেকেই ২৯শে সেপ্টেম্বর পল্টনের জনসভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রথম শ্রেণীর মাজিষ্ট্রেট সভায় সরকারী শর্টহ্যান্ড রিপাের্ট এটাষ্ট করেন। হাকিম তাহার রায়ে শেখ মুজিবের বক্তৃতার সরকারী শর্টহ্যান্ড নােটের অনুলিপি (ট্রান্সক্রিপশন) সহ সরকারী সাক্ষীদের সাক্ষ্যের বিস্তারিত পর্যালােচনা করেন।
সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিস্তারিত পর্যালােচনা করিয়া বিজ্ঞ হাকিম এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মামলার সাক্ষ্য প্রমাণগুলি শুধু পরস্পর বিরােধীই নয়, সম্পূর্ণ মামলার একমাত্র ভিত্তি সরকারী শর্টলিপির অনুলিপিরও পরস্পরবিরােধী।
কোর্টের নিকট দাখিলকৃত যেসব প্রমাণটি (এক্সিবিট) বক্তৃতার অনুলিপি হিসাবে পেশ করা হয়, তাহা যেমন সরকারী রিপাের্টার জনাব মােজাম্মেল হকের রিপাের্ট বলিয়া অস্বীকৃত হয়, তেমনি ইহা তাহার অনুলিপি বলিয়াও অস্বীকার করা হয়। সরকারী রিপাের্টারের ৬ষ্ঠ প্রমাণের যে ১নং উপপ্রমাণটি আদালতে দাখিল করা হয় উহাতেও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সম্মতি গ্রহণ করা হয় নাই বা সরকারী রিপাের্টার তাঁহার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া সে।
প্রমাণপত্রটি অফিস হইতে পাইতে পারেন না বলিয়া নিজেই স্বীকার করিয়াছেন। সেই দলিল বা কাগজপত্র কিভাবে তিনি পাইলেন, তাহারও কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেন নাই। বিজ্ঞ হাকিম আরও লক্ষ্য করেন যে, যদিও ঘটনার দুই মাস পর অভিযােগকারী এজহার দান করেন, তথাপি নিজস্ব পুলিশ অফিসার কর্তৃক লং হ্যাণ্ডে গৃহীত রিপাের্ট তদন্তকার্য্যের সময় কেন পাঠ করিয়া দেখেন নাই, তাহার কোন কারণ দর্শাইতে পারেন নাই। ম্যাজিষ্ট্রেট রায়ে বলেন যে, উহা যদি বক্তৃতার প্রকৃত দলিল বলিয়াই যথােপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমােদিত হইয়া থাকে তবে সরকারী রিপাের্টারের এই অনুলিপিতে এজাহারের ভিত্তি রহিয়াছে কিনা তাহাও কেন। পর্যালােচনা করিয়া দেখা হইল না, অভিযােগকারী ইহারও কারণ দর্শাইতে পারেন নাই। তদুপরি সরকারী রিপাের্টার কর্তৃক বক্তৃতার অনুলিপিও তাঁহার নিজস্ব অনুলিপি বলিয়া অস্বীকৃত হইয়াছেন।
অতএব, সম্পূর্ণ অভিযােগটি প্রমাণ করিতে বাদী শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইয়াছেন বলিয়া হাকিম অভিমত প্রকাশ করেন। তদন্তকারী অফিসারগণ মামলা দায়ের করার পর সাক্ষীদের পরীক্ষা করিয়াছেন বলিয়া দাবী করিলেও কতিপয় সাক্ষী উহা অস্বীকার করায় ম্যাজিষ্ট্রেট অনুরূপভাবে তদন্তকাৰ্য্যের নিন্দা করেন।
ম্যাজিষ্ট্রেট আরও বলেন যে, পরস্পরবিরােধী সাক্ষ্য ও ইহাদের ধরন দেখিয়া মনে হয় যে, অভিযােগ প্রমাণের জন্য বেশকিছু সংখ্যক অবাঙ্গালী ব্যক্তিকে ধরিয়া আনা হইয়াছে এবং তাহারা সাজানাে ও শিখানাে বুলি আওড়াইয়াছেন, এমনকি তাঁহারা আপত্তিকর বলিয়া কথিত বক্তৃতাও উপস্থাপন করিতে ব্যর্থ হইয়াছেন।
বিজ্ঞ হাকিম তাঁহার রায়ে বলেন যে, ঘটনার দীর্ঘদিন পর প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আফসার উদ্দিন আহমদও একজন বাঙ্গালী শ্রোতা যেখানে শেখ মুজিবের বক্তৃতা স্মরণ রাখিতে পারেন নাই, সেখানে কয়েকজন অবাঙ্গালী (ননবেঙ্গলী) শ্রোতা কেমন করিয়া ইহা মনে রাখিতে ও দীর্ঘদিন পর উপস্থাপন করিতে পারিলেন, তাহা তিনি বিশ্বাস করিতে পারেন না।
অতএব, ম্যাজিষ্ট্রেট মনে করেন যে, বাদীপক্ষ শুধু যেন-তেন প্রকারেই মামলাটি খাড়া করেন নাই, তদুপরি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার অভিযােগসমূহ প্রমাণ করিতেও ব্যর্থ হইয়াছেন। সুতরাং তিনি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত সমুদয় অভিযােগ বাতিল করিয়া দেন।
শেখ মুজিবের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন মেসার্স আবদুস সালাম খান, জহিরউদ্দিন, আবুল হােসেন, এম, এ, রব প্রমুখ এডভােকেট।
সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মেসার্স সােহরাব বখত ও এম, এ, খালেক খান।
গতকল্য আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত মামলার রায়দান অনুষ্ঠানে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগমসহ বহুসংখ্যক আওয়ামী লীগ কর্মী উপস্থিত থাকেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!