দৈনিক ইত্তেফাক
২১শে মে ১৯৬৬
সুদূর সিন্ধু অঞ্চলে ৬-দফার সমর্থনে অকুণ্ঠ সাড়া
নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনমত গড়িয়া তােলার জন্য কর্মী সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ
হায়দরাবাদ, ১৫ই মে।- সাবেক সিন্ধু প্রদেশের আওয়ামী লীগ কর্মীদের এক সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে সিন্ধু আওয়ামী লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান প্রণীত ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে। পশ্চিম পাক আওয়ামী লীগ নেতা জনাব খলিল আহমদ তিরিমিজি এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। বিগত সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের ফলে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার যেসব নূতনতর দিক উদঘাটিত হইয়াছে, সিন্ধু আওয়ামী কর্মীদের সম্মেলনে তা বিবেচনা করা হয়। সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে দেশের শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাদি সমাধানের জন্য যেসব পরিকল্পনা ও প্রস্তাব পেশ করা হইয়াছে, সেইসব এই সম্মেলনে বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করিয়া দেখা হয়। পরীক্ষানিরীক্ষার পর সম্মেলনে শেখ মুজিবর রহমানের ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন স্থাপন করে। সম্মেলনে উপস্থিত আওয়ামী লীগ কর্মীরা মনে করে যে, বর্তমানে দেশ যেসব সমস্যার সম্মুখীন রহিয়াছে, সেই সব সমস্যা সমাধানের জন্য ৬-দফা একটি আদর্শ সমাধান। ৬-দফা শুধু দেশের শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রয়ােজনই মিটায় না কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাংক্ষা বাস্তবায়নের পথেও সহায়ক হইবে।
পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেম, দেশের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত বলিয়া সম্মেলনে ঘােষণা করা হয়। রাজনৈতিক দিক দিয়া দেশের উন্নয়ন ও সকল অঞ্চলের মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করার জন্য কর্মীরা প্রস্তুত আছেন বলিয়া ঘােষণা করা হয়। ৬-দফার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়া জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে সম্মেলনের পক্ষ হইতে সাংগঠনিক কমিটিকে নির্দেশ দান করা হয়। কায়েমী স্বার্থবাদের ক্ষমতা আঁকড়াইয়া রাখার এবং কায়েমী স্বার্থকে জোরদার করার প্রয়াসকে জনসমক্ষে তুলিয়া ধরার জন্যও সম্মেলন সাংগঠনিক কমিটিকে নির্দেশ দেয়।
সম্মেলনে গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে সিন্ধুর আওয়ামী লীগ কর্মীদের এই সম্মেলন এক ইউনিট প্রথা লােপ করিয়া সাবেক প্রদেশসমূহকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবী জানান হয়। স্বাভাবিক রাজনৈতিক পদ্ধতিতে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশটি বাতিল করার জন্য সরকারের চাপ সৃষ্টি করার জন্য কর্মীরা সাংগঠনিক কমিটিকে নির্দেশ দেয়। সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, এক ইউনিট ব্যবস্থা, ব্যর্থ হইয়াছে। এতে সমস্যা সমাধানে সাফল্য অর্জন হয় নাই, নূতনতর সমস্যার সৃষ্টি হইয়াছে। সাবেক সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশের ক্ষুদ্রাঞ্চলসমূহে আমলাতান্ত্রিক ও তার স্বাভাবিক দোষত্রুটি দেখা দিয়া সাধারণ মানুষের জন্য অসীম দুর্ভোগের সৃষ্টি করিয়াছে। প্রস্তাবে বলা হয় যে, ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক পাকিস্তান প্রস্তাবে এবং ১৯৪৬ সালের দিল্লী লেজিসলেটর কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবে পাকিস্তানের বিভিন্ন ইউনিটের জন্য সুস্পষ্টভাবে স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে। কায়েদে আজম নিজেও বিভিন্ন প্রদেশকে তাদের নিজ নিজ সত্তা বজায় রাখিতে দিয়াছিলেন। ক্ষুদ্রতার অঞ্চলসমূহের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের খাতিরে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলবাসীদের দুর্ভোগ মােচনের জন্য এবং সর্বোপরি সুষ্ঠ সরকার প্রতিষ্ঠাকল্পে এক ইউনিট ব্যবস্থা আশু বাতিল করা প্রয়ােজন।
সম্মেলনের তরফ হইতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান হয়। সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে স্বাভাবিকভাবে রাজনীতি চর্চা এবং সংবাদ পরিবেশনে সংবাদপত্রের চিরন্তন স্বাধীনতার নানাবিধ প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হইতেছে বলিয়া অভিযােগ করা হয়। জরুরী অবস্থার দোহাই দিয়া রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সংবাদপত্র বিশেষকে হয়রানি করা হইতেছে বলিয়াও অভিযােগ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি সংবাদপত্রকেই সঠিক সংবাদ দানের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে।
শেখ মুজিবর রহমানসহ অপরাপর যেসব নেতাকে অনাহুত হয়রানির শিকারে পরিণত করা হইয়াছে, তাহাদের প্রতি সম্মেলনের তরফ হইতে গভীর সহানুভূতি জ্ঞাপন করা হইয়াছে। অবিলম্বে মহান নেতা শেখ মুজিবর রহমানের উপর হইতে সকল হয়রানির অবসান ঘটাইয়া সকল রাজবন্দীর আশু মুক্তি দাবী করিয়া একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
সাবেক সিন্ধু আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য সৈয়দ জি, এ, খান আহমদ বােখারীকে আহ্বায়ক করিয়া ৯-সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হইয়াছে। কমিটির অন্যান্য সদস্য হইতেছেনঃ মেসার্স সৈয়দ শাকীর বােখারী, ডক্টর মজিদ নিজামী, শফি মােহাম্মদ মেনন (এডভােকেট, সাধারণ সম্পাদক), মুরিদ হােসেন খান কামরানী, সালাহউদ্দিন আব্বাসী, রাইস তাজিয়া খান, মীর মােহাম্মদ মর্তুজা এবং রাজা আকবর আলী। -সংবাদদাতা প্রেরিত
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব