দৈনিক ইত্তেফাক
১৪ই মে ১৯৬৬
নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন স্তব্ধ করার অপচেষ্টা হইতে বিরত থাকিয়া
অবিলম্বে আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাও
প্রতিবাদ দিবসে প্রদেশের দিকে দিকে বিক্ষুব্ধ মানুষের ক্রুদ্ধ গর্জন
অবিলম্বে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করিয়া রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে
যত্নবান হওয়ার আহ্বান
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
“দেশের বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বজন-স্বীকৃত নিয়মতান্ত্রিক পদে পরিচালিত আন্দোলন স্তব্ধ করার অপচেষ্টা হইতে বিরত থাকিয়া কারাগারে আটক নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি দাও, অন্যথায়, এদেশের ভাগ্যবঞ্চিত কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত সমাজ নিজেরাই নিজেদের পথ বাছিয়া লইয়া এমন দুর্বার আন্দোলনে ঝাপাইয়া পড়িবে, যে আন্দোলনের মুখে শত বাধাও আর তিষ্ঠিতে পারিবে না।”
গতকালকার (শুক্রবার) “প্রতিবাদ দিবসে” পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভার বক্তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত এই সতর্কবাণী পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশেও যেন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। মফস্বল এলাকা হইতে প্রাপ্ত সংবাদে দেখা যায়, আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবীতে সর্বত্র এই একই আওয়াজ ক্রুদ্ধ আক্রোশে ফাটিয়া পড়িয়াছে। বিক্ষুব্ধ মিছিলের পদচারণায়। আর অযুতকণ্ঠে উচ্চারিত “মুক্তি চাই” ধ্বনিতে প্রতিটি মােকামই প্রকম্পিত হইয়াছে। আর ফেনিল আক্রোশের সে ক্রুদ্ধ গর্জনে কণ্ঠ মিলাইয়াছে। এদেশের ভাগ্যহত দরিদ্র শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী- সকল সম্প্রদায়ের মানুষ।
৬-দফার প্রবক্তা নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবীতে আগাইয়া আসিয়াছে এদেশের হাজার হাজার শ্রমিক। পল্টন ময়দানের বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়াইয়া চটকল ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে ধ্বনিত হইয়াছেঃ অবিলম্বে নেতৃবৃন্দের মুক্তি দেওয়া না হইলে প্রদেশের কল-কারখানার চাকা স্তব্ধ হইয়া যাইবে। ইহারই পাশাপাশি সভার উদ্যোক্তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হইয়াছে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ ধাপে ধাপে কর্মক্ষেত্রে আগাইয়া যাইবে। সুতরাং অবিলম্বে নেতৃবৃন্দের মুক্তি দেওয়া না হইলে অচিরেই প্রদেশব্যাপী সাধারণ হরতালের কর্মসূচী ঘােষিত হইবে।
জনাব আবদুল মান্নান
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, নেতৃবৃন্দের আটকে চটকল শ্রমিকদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাইয়া পূর্ব পাকিস্তান চটকল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান তুমুল করতালির মধ্যে ঘােষণা করেন যে, আজ যেমন কারখানার চাকা স্তব্ধ করিয়া দিয়া ৪০ হাজার চটকল শ্রমিক ময়দানের জনসভায় শরীক হইতে আসিয়াছে, তেমনি অচিরেই যদি নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেওয়া না হয়,তবে প্রদেশের সকল কারখানার চাকা কিভাবে স্তব্ধ করিতে হয়, তাহা আমরা জানি। এই প্রসঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগের নিকট হইতে সুস্পষ্ট কর্মসূচী আহ্বান করেন।
জনাব মান্নান দুঃখের সহিত বলেন যে, গত কয়েক বৎসরের সীমাহীন অভাব-অভিযােগের প্রতিকারের জন্য আজ যখন এদেশের একটি মাত্র দৃঢ়চিত্ত নির্ভীক সন্তান জীবনের উপর বিরাট ঝুঁকি লইয়া দেশবাসীকে নিয়মতান্ত্রিক পথে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে আসিয়াছেন, ঠিক তখনই তাঁহাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হইয়াছে। তিনি বলেন, সরকার যেন স্মরণ রাখেন যে, এদেশের শ্রমিক সমাজ দল-মত বুঝে না। জনগণের স্বার্থ লইয়া যিনি সংগ্রাম করেন তিনিই তাহাদের নেতা। তাই, প্রদেশের চটকল শ্রমিকরা আজ তাহার ও তাঁহার সহকর্মীদের আটকে এত বিক্ষুব্ধ। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি ঘােষণা করেন যে, অবিলম্বে নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেওয়া না হইলে এদেশের ভুখা-নাঙ্গা চাষীরাও লাঙ্গল বন্ধ করিয়া শ্রমিক ভাইদের কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া সংগ্রামে নামিবে।
রফিকুল হােসেন
আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল হােসেন তাহার স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে সংক্ষিপ্ত এক বক্তৃতায় রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালিত আন্দোলন স্তব্ধ করার পরিণাম সম্পর্কে সরকারকে হুঁশিয়ার করিয়া দেন। তিনি বলেন যে, ভারতের সহিত যুদ্ধের সময় জরুরী অবস্থা ঘােষণা প্রয়ােজন ছিল, একথা যেমন ঠিক, তেমনি তাসখেন্দ ঘােষণা ও সীমান্ত হইতে আমাদের বীর যােদ্ধাবাহিনীকে যুদ্ধপূর্ব স্থানে সরাইয়া আনিয়া সরকার নিজেই প্রমাণ করিয়াছেন যে, দেশে জরুরী অবস্থা আজ আর নাই। এতদসত্ত্বেও দেশরক্ষা বিধিবলে নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের মধ্যদিয়া সরকার প্রমাণ করিলেন যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যেই দেশে আজও জরুরী অবস্থা বহাল রাখা হইয়াছে। তিনি বলেন যে, সব জারিজুরি আজ জনসাধারণ ধরিয়া ফেলিয়াছে। অতএব, ক্ষমতাসীনদের নিজ স্বার্থেই অবিলম্বে দেশ হইতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা কর্তব্য। অন্যথায় দেশবাসীর দৃপ্ত পদচারণায় জরুরী অবস্থার আর কোনই সার্থকতা থাকিবে না। অতএব, শুভস্য শীঘ্রম।
ঢাকার পল্টন ময়দানের গতকালকার প্রতিবাদ সভা নানা দিক দিয়া বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল। সভা শেষে সহস্র সহস্র জনতা বিক্ষোভ মিছিল করিয়া পল্টন ময়দান হইতে সদরঘাট ও চকবাজার হইয়া শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মাজারে গমন করে।
আন্দোলনের মুখে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে পুরিয়া দেওয়ার রীতি প্রদেশের সনাতন রীতি। কিন্তু নেতৃবৃন্দকে আটকের প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনসাধারণ যে কতখানি বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিতে পারে, তাহার একটি জ্বলন্ত স্বাক্ষর রাখিয়া গিয়াছে গতকালকার পল্টনের বিপুল জনসমাবেশ। ব্যক্তিবিশেষের বক্তৃতা শােনার জন্য জনতা জনসভায় ভীড় করে বলিয়া যে বিশ্বাস অনেকের মনে চিরন্তন হইয়া দেখা দিয়াছিল, গতকালকার সভা জনসমাবেশ সে বিশ্বাসকে চূর্ণবিচুর্ণ করিয়া দিয়াছে। নেতার চেয়ে যে নীতি বড় এবং নেতার অবর্তমানে নীতিকে সমুন্নত রাখিয়া জনগণও যে বাধা-বিঘ্ন পদদলিত করিয়া সঠিক পথে আগাইয়া চলিতে পারে, গতকালকার সভা তাহারই জলজ্যান্ত প্রমাণ বহন করে। শেখ মুজিবর রহমান প্রণীত ও আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অনুমােদিত ৬-দফা যে আজ ব্যক্তিবিশেষ বা দলবিশেষের সম্পদ নয়, ৬-দফাকে এ প্রদেশের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ যে তাদের নিজেদের সম্পদ হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে গতকাল প্রতিবাদ দিবস উপলক্ষে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সভা ও শােভাযাত্রার মধ্যদিয়া তাহাই প্রতিভাত হইয়াছে।
গতকালকার পল্টনের জনসভা পল্টনে অনুষ্ঠিত বৃহত্তম জনসভাসমূহের অন্যতম। সভা যখন শেষ হইতে চলিয়াছে, তখনও দূর-দূরান্ত হইতে প্ল্যাকার্ড-ফেষ্টুনসহ বিক্ষোভ মিছিল আসিয়া সভায় শরীক হইতে থাকে। আদমজী নগরের শিল্প এলাকায় গতকাল আর চাকা ঘুরে নাই। সহস্র সহস্র শ্রমিক তাহাদের কাজ কামাই করিয়া মিছিল করিয়া সুদীর্ঘ নয় মাইল রাস্তা পায়ে হাঁটিয়া পল্টনের প্রতিবাদ সভায় আসিয়া নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবী বুলন্দ করিয়া তুলে। গতকালের জনসভায় অনলবর্ষী বাগ্মীর অভাব ছিল; কিন্তু জনতার উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার মধ্যে সে অভাব তলাইয়া গিয়াছে। কে বক্তৃতা করিতেছেন, বক্তা নেতা কি কর্মী সেদিকে দৃষ্টিপাত করার কোন তাগিদই শ্রোতাদের ছিল না। জনসভায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি শ্রোতা প্রতিবাদমুখর। তাই সভা চলাকালীন মুহুর্মুহু অযুতকণ্ঠে উচ্চারিত নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবীতে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত হইতে থাকে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পল্টন ময়দানের জনসভায় বক্তৃতা করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জনাব আবদুল মমিন এ্যাডভােকেট, সমাজকল্যাণ সম্পাদক জনাব কে, এম, ওবায়দুর রহমান, শেখ ফজলুল হক (মনি), শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, জনাব এম,এ, রব এ্যাডভােকেট, শ্রমিক নেতা জনাব মকবুল হােসেন, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব জহিরুদ্দীন, পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান ও সহ-সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুর রহমান।
জনসভায় প্রস্তাব পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মতিউর রহমান এবং প্রস্তাব সমর্থন করেন জনাব রফিকুল হােসেন। শ্রোতৃমণ্ডলীর স্বতঃস্ফূর্ত হস্তোত্তোলনের মধ্যদিয়া প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়।
জহীরুদ্দীন
পল্টনের জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জহীরুদ্দীন ঘােষণা করেন যে, শেখ মুজিব না থাকিলেও তাঁহার প্রণীত ৬-দফা যে থাকিবে, তাহার প্রমাণ আজিকার এই জনসভা। আজ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, ৬-দফা মুজিবর রহমানের নয়, ৬-দফা পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের। তিনি বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ যাহাতে ন্যায়বিচার পাইতে পারে এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববােধের ভিত্তিতে যাহাতে একটি শক্তিশালী পাকিস্তান কায়েম করা সম্ভব হয়, সেই উদ্দেশ্য লইয়াই ৬-দফা প্রণয়ন করা হইয়াছে। ব্যক্তিবিশেষ যুগ যুগ ধরিয়া ক্ষমতায় থাকুন, তাহাতে আমাদের কোন আপত্তি নাই, আমরা চাই দেশের দশ কোটি মানুষের মৌলিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান।
প্রদেশের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে জনাব জহিরুদ্দীন বলেন যে, খাদ্য লইয়া রাজনীতি চলে না। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসাবে আমরা আমাদের দেশবাসীকে ভুখা মরিতে দিতে পারি না।
জনাব জহিরুদ্দীন দেশরক্ষা বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষাব্যবস্থার প্রশ্নে বিরােধী দলের ভূমিকা ও ক্ষমতাসীনদের ভঁওতামূলক ঘােষণার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণ কারখানা স্থাপনের দাবী করায় এই সেদিনও যাহারা বিরােধী দলের প্রতি গালিগালাজ করিয়াছেন, অধুনা আবার তাহারাই এই প্রদেশে অস্ত্র নির্মাণ কারখানার প্রশ্নে বাহবা কুড়াইবার জন্য নিত্যনূতন ‘ঘোষণা করিয়া চলিয়াছেন। তুমুল করতালির মধ্যে তিনি ঘােষণা করেন, দেশরক্ষা বিধির অপপ্রয়ােগ করিয়া শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা সম্ভব। কিন্তু প্রদেশের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষই প্রতি ঘরে ঘরে এক একজন মুজিব হইয়া আত্নপ্রকাশ করিবে এবং ইহাদের সকলের ঠাই হয়-এমন কারাগার এ-দেশে নাই। তিনি সভায় যােগদানকারী শ্রমিকদের অভিনন্দন জানাইয়া বলেন যে, যাতায়াতের বাস বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তথাপি শ্রমিক বন্ধুরা দমিয়া যান নাই। সুদূর আদমজী নগর হইতে নয় মাইল হাঁটিয়া তাহারা সভায় আসিয়াছেন।
জনাব মােমিন
জনতার বক্তৃতা প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জনাব আবদুল মােমিন এ্যাডভােকেট বলেন যে, জনসাধারণ ৬-দফা অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করার ফলেই ৬-দফা প্রণেতাকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। তিনি বলেন যে, দরিদ্র জনসাধারণ, কৃষক ও শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া উত্থাপন। করিয়া অতীতেও অনেকে কষ্ট পাইয়াছেন এবং এখনও পাইতেছেন। তিনি বলেন যে, জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা তুলিয়া ধরার ক্ষেত্রে যত জেল-জুলুম ও অত্যাচারই আসুক না কেন, ৬-দফা দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলিতে থাকিবে।
ওবায়দুর রহমান
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক জনাব কে, এম,ওবায়দুর রহমান বলেন যে, জনগণের দাবী অবদমিত করার জন্যই প্রথমে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। তিনি বলেন যে, নেতৃবৃন্দের অবর্তমানে দেশের আপামর জনসাধারণই নিজেদের দাবী নিজেরাই প্রতিষ্ঠা করিবে। তিনি প্রশ্ন করেন যে, যে সরকার দেশে-বিদেশে কাশ্মীরে গণভােটের দাবীতে উচ্চকণ্ঠ, সে সরকার কেন নিজ দেশে বিভিন্ন প্রশ্নে গণভােট দিতে প্রস্তুত নয়?
শেখ ফজলুল হক (মনি)
শেখ ফজলুল হক (মনি) তাঁহার বক্তৃতায় ৬-দফার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। ৬-দফা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, দেশরক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইলে উহা সামগ্রিকভাবে দেশের দেশরক্ষা শক্তি বর্ধিত করিবে। তিনি কর্মী-যুবক-জনতাকে শেখ মুজিবর রহমানের আহ্বানে ৬-দফা দাবী আদায় করার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হইতে আহ্বান জানান।
জনাব মােয়াজ্জেম হােসেন
প্রাক্তন ছাত্রনেতা শাহ মােয়াজ্জেম বলেন যে, জনদাবী প্রকাশ করার জন্যই প্রথমে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মােট ১০টি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু ইহাতেও তিনি স্তব্ধ না হওয়ায় তাঁহাকে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার গ্রেফতারের মধ্যদিয়াই ৬-দফার বিজয় সূচিত হইয়াছে। দেশবাসী ৬-দফাকে গ্রহণ করিয়াছে বলিয়াই নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হইয়াছে।
এডভােকেট এম এ রব
এডভােকেট জনাব এম এ রব তাহার বক্তৃতায় দেশরক্ষা বিধির আনুপূর্বিক ইতিহাস বর্ণনা করিয়া বলেন, চার বৎসরব্যাপী প্রথম মহাযুদ্ধ সমাপ্ত হইবার তিনমাস পরে তদানীন্তন বিদেশী সরকার মাত্র তিন মাসের মধ্যে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে দেশ হইতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করেন। অথচ মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধের পর আট মাস অতীত হইতে চলিলেও জরুরী অবস্থা যুদ্ধকালীন সময়ের মতই বহাল রাখা হইয়াছে।
নারায়ণগঞ্জ
৬-দফার প্রবক্তাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে শিল্প শহর নারায়ণগঞ্জ গতকাল (শুক্রবার) প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে। অপরাহ্নে প্রায় দুই সহস্র শ্রমিক ও আওয়ামী লীগ কর্মী একবিরাট মিছিল সহকারে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। অতঃপর তাঁহারা নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ অফিস প্রাঙ্গণে এক সভায় মিলিত হন। শহর আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব কসিরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় বিভিন্ন বক্তা শেখ মুজিবর রহমানসহ অপরাপর আওয়ামী লীগ নেতার গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি ও জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের দাবী করা হয়। প্রস্তাবে যত্রতত্র পাকিস্তান রক্ষাবিধি প্রয়ােগের নিন্দা করা হয়। সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান উচ্চমূল্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া অবিলম্বে দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি রােধের ব্যবস্থা করার দাবী জানান হয়। দাউদকান্দিতে প্রতিবাদ। গতকাল দাউকান্দিতে স্থানীয় জনসাধারণ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। জনসাধারণ খণ্ড খণ্ড শােভাযাত্রা বাহির করে এবং দোকানপাট বন্ধ রাখে। মিছিলের পর জনসাধারণ স্থানীয় মাঠে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হন এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ আটক সকল রাজবন্দীর আশু মুক্তি দাবী করে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব