You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.04.17 | সম্মুখ সমরের শেষ অঙ্ক | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
১৭ই এপ্রিল ১৯৬৬

‘সম্মুখ সমরের শেষ অঙ্ক
(স্টাফ রিপাের্টার)

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভূট্টো ৬-দফার প্রশ্নে একই মঞ্চে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবরের মােকাবিলা করার যে চ্যালেঞ্জ দিয়াছিলেন এবং এই চ্যালেঞ্জকে কেন্দ্র করিয়া সরকারী ও বিরােধী পক্ষের দুই নেতার ‘সম্মুখ সমরের দৃশ্য দেখিবার জন্য সাধারণ্যে যে ঔৎসুক্য জাগিয়াছিল, শেষ পর্যন্ত জনাব ভুট্টোর পক্ষে তাহার সংকল্পে স্থির থাকা সম্ভব না হওয়ায় প্রস্তাবিত মােকাবিলা সভার সকল সম্ভাবনা তিরােহিত হইয়াছে। যে কারণে প্রস্তাবিত ‘সম্মুখ সমরের শেষাঙ্কের যবনিকাপাত হইল, শুক্রবার অপরাহ্নে আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে তাহার বিবরণ দিয়া একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। এই সংবাদ পাইয়া জনাব ভুট্টোও ঐদিন শেষ রাত্রের দিকে একটি বিবৃতি দিয়া মােকাবিলা সভার প্রস্তুতি প্রচেষ্টার যবনিকাপাতের নিজস্ব ব্যাখ্যা দেন।
শুক্রবার অপরাহ্নে আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে প্রদত্ত বিবৃতিটিতে বলা হয়ঃ ৬-দফা সম্পর্কে আলােচনার জন্য ১৭ই এপ্রিলের জনসভার পদ্ধতি সম্পর্কে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে পূর্বদিন রাত্রের ব্যবস্থামত গতকাল (শুক্রবার) ১২-৩০ টায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জহিরুদ্দিন এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজুদ্দিন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব জেড, এ, ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রাদেশিক শিল্পমন্ত্রী এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সরকারী দলের নেতা দেওয়ান আবদুল বাসিত, রাজস্ব মন্ত্রী ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ এডহক কমিটির সম্পাদক জনাব ফজলুল বারী এবং প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী জনাব আমজাদ হােসেনও এই সময়ে উপস্থিত ছিলেন।
“জনাব ভুট্টো আওয়ামী লীগ নেতাদেরও জানান যে, তিনি স্বয়ং ১৭ই এপ্রিল জনসভায় ৬-দফার উপর বিতর্কের জন্য তাঁহার প্রস্তাবে অবিচল থাকিতে আগ্রহশীল থাকিলেও চেয়ারম্যান লিও শাও চী’র সফর উপলক্ষে ব্যস্ত থাকার জন্য মুসলিম লীগ নেতারা উক্ত জনসভার আয়ােজন করিতে তাহাদের অক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছেন। মুসলিম লীগ নেতাদের অসুবিধা বিবেচনা করিয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নিজেরাই ঐদিনের সভানুষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে রাজী আছেন বলিয়া জানান। কিন্তু ইহাতেও তাহারা সম্মত হন না। শেষ মুহূর্তে মুসলিম লীগ অনুরূপ মনােভাব গ্রহণ করায় জনাব ভুট্টো কর্তৃক নির্দিষ্ট ১৭ই এপ্রিলের জনসভার সম্ভাবনা তিরােহিত হয়।
“এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, জনাব ভুট্টোর প্রথম চ্যালেঞ্জের পর আওয়ামী লীগ তাহা সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করে। পরে জনাব ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে তাঁহার বর্তমান অবস্থানের সময় একই মঞ্চ হইতে ছয়-দফার উপর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। শেখ মুজিব এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং জনাব ভুট্টোকে আগামী ২৪শে এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়ােজিত জনসভায় যােগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। জনাব ভুট্টো নিজেই ১৭ই এপ্রিল তাঁহার পক্ষে সভার জন্য সুবিধাজনক তারিখ হইবে বলিয়া স্থির করেন। শেখ মুজিব পূর্বেকার কর্মসূচী থাকা সত্ত্বেও ১৭ই এপ্রিল জনসভা অনুষ্ঠানের জন্য জনাব ভুট্টোর প্রস্তাব মানিয়া লন এবং তাঁহার কর্মসূচী বাতিল করিয়া জনাব ভুট্টোর সঙ্গে পরামর্শক্রমে জনসভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনাব তাজুদ্দিনের উপর ভার দেন। জনাব ভুট্টো সকল সময়েই ১৭ই এপ্রিল জনসভা অনুষ্ঠানের জন্য আগ্রহ দেখাইলেও উপরের বর্ণিত অবস্থায় তাহার প্রস্তাবের আর কোন মূল্যই রহিল না।
জনাব ভুট্টোর বিবৃতি
৬-দফার প্রশ্নে শেখ মুজিবের সহিত মােকাবিলার সকল সম্ভাবনা তিরােহিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে তৎসংক্রান্ত সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করিয়া শুক্রবার অপরাহ্নে বিবৃতি দেওয়ার খবর প্রাপ্তির পর ঐদিন রাত্রি ২টা ২০ মিনিটে জনাব ভুট্টো যে বিবৃতি দেন, নিম্নে তাহার বিবরণ প্রদত্ত হইলঃ
“ছয়-দফা সম্পর্কে জনসমাবেশে মােকাবিলার প্রশ্নে ঘটনাপঞ্জী এবং আসল তথ্যাবলী নিম্নরূপঃ
“১৪ই তারিখে শেখ মুজিবর রহমান সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে জানান যে, ২৪শে এপ্রিল তারিখে মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যুক্ত উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠানে তিনি সম্মত আছেন। তিনি অবশ্য ইহাও উল্লেখ করেন যে, উক্ত তারিখের পূর্বেও তিনি মােকাবিলায় প্রস্তুত আছেন।
“একই দিনে আমি এক বিবৃতিতে ১৭ই তারিখে সাক্ষাতের বাসনা প্রকাশ করি। কারণ ১৯শে তারিখে আমাকে আঙ্কারা রওয়ানা হইতে হইবে। শেখ মুজিবর রহমানের সুপারিশ মােতাবেক উভয় দলের যুক্ত উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্য আমি পাকিস্তান মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারীর নিকটও একটি তারবার্তা প্রেরণ করি। একই দিবসে জনাব তাজউদ্দিন আমার নিকট একখানি পত্র প্রেরণ করেন। এই পত্রে তিনি সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তিনটি শর্ত আরােপ করেনঃ (ক) পল্টন ময়দান নামে সুপরিচিত আউটার স্টেডিয়ামেই জনসভার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
(খ) ১৭ই এপ্রিল অপরাহ্ন চার ঘটিকায় সভার সময় নির্দিষ্ট করিতে হইবে।
(গ) আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের যুক্ত উদ্যোগে জনসভার আয়ােজন করিতে হইবে।
“হাইকোর্টের কোন বিচারপতিকে সভাপতি করার জন্যও পত্রে সুপারিশ করা হয়। একই দিন অপরাহ্নে জনাব তাজউদ্দিন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
“সময়ের স্বল্পতার দরুন জনাব তাজউদ্দিন মুসলিম লীগের সেক্রেটারী জেনারেলের ভূমিকা সংক্রান্ত পূর্ববর্তী প্রস্তাব স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার করেন এবং তদস্থলে যুক্ত সভা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি করার জন্য প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারীর নাম সুপারিশ করেন।
“১৫ই তারিখ সকালে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সহিত যােগাযােগ করা হয়। তিনি রাজনৈতিক সভার সহিত বিচার বিভাগকে জড়িত করিতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। ফলে আওয়ামী লীগের এতদসংক্রান্ত সুপারিশ কার্যকরী করা সম্ভব হয় নাই। জনসভার পদ্ধতি চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় সাড়ে বারােটার দিকে জনাব তাজউদ্দিন পুনরায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। মুসলিম লীগের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের জনাব জহিরউদ্দিনও এই সময় উপস্থিত ছিলেন। বিস্তারিত আলােচনার পর উভয়পক্ষই একমত হন যে, এত স্বল্পসময়ে এতবড় একটা গুরুত্বপূর্ণ জনসভার প্রয়ােজনীয় যাবতীয় এন্তেজাম সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ বােধগম্য কারণে ১৭ই তারিখের জনসভা অনুষ্ঠান সম্ভব নয় বলিয়া উভয়পক্ষই উপলব্ধি করেন। ইহাও স্থিরকৃত হয় যে, সময়ের স্বল্পতার দরুন এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সভা আহ্বান সম্ভব নয়—এই মর্মে উভয় দলের কর্মকর্তাদের যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হইবে।
“বৈঠকে উপস্থিত সকলে উক্ত মর্মে একমত হওয়ার পর বৈঠক মুলতবী রাখা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক পৃথক বিবৃতি প্রকাশে আমি বিস্মিত হইয়াছি।
তদুপরি এই বিবৃতিতে ঘটনাবলীর প্রকৃত বর্ণনা দেওয়া হয় নাই। আমি এখানে পুনর্বার উল্লেখ করিতেছি যে, আশু সভা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ১৪ই তারিখে শেখ মুজিবের বিবৃতি ও জনাব তাজউদ্দিনের পত্রের শর্তাবলী পূরণে আমি সকল দিক দিয়াই সহযােগিতা করিয়াছি।
শুক্রবার অপরাহ্নে উভয় দলের বৈঠকের এই তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনায় ইহা পরিষ্কার হইয়াছে যে, পূর্ণ শুভেচ্ছা ও আন্তরিকতা সত্ত্বেও এই মাসের ১৭ই তারিখে যুক্ত সভা অনুষ্ঠান সম্ভব হয় নাই। এই তারিখে সভার আয়ােজন করা সম্ভব হয় নাই বটে; কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, শেখ মুজিবকে মােকাবিলার জন্য আমার পূর্বোক্ত ঘােষণা হইতে আমি কোনক্রমে বিচ্যুত হইয়াছি। বরঞ্চ আমার সর্বপ্রকার সহযােগিতা সত্ত্বেও সভা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় আমি হতাশ।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব