সংবাদ
১৩ই এপ্রিল ১৯৬৬
৬-দফা দাবী প্রসঙ্গে দিনাজপুরের জনসভায় মুজিবরের মন্তব্য
আমরা কাহারও করুণার উপর নির্ভরশীল থাকিতে চাহি না
দিনাজপুর, ১০ই এপ্রিল। আজ এখানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন যে, কাহারা দেশ ও জনগণের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে, উহা বিচারের ভার জনগণের উপর। কেননা আদালতে তাহাদের বিচার হইতে পারে না। তিনি জনতার উদ্দেশে বলেন, আমারও ভােটাধিকার নাই, আপনাদেরও ভােটাধিকার নাই; আসুন আমরা সবাই মিলিয়া ভােটাধিকার অর্জন করি।
দৈনিক ইত্তেফাক’ পরিবেশিত জনসভার বিবরণে আরও বলা হয় যে, শেখ সাহেব ঘােষণা করেন; আমি বিশ্বাস করি, জনসাধারণই প্রকৃত শক্তির উৎস এবং এবং জনতার দরবারই আল্লার আদালতের পরে শক্তিশালী আদালত। তাই আপনাদের উপরই বিচারের ভার দিলাম আপনাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।
শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেন যে, আমরা চীন বা আমেরিকা কাহারাে দালাল নই। আমরা আমাদের দেশবাসীরই দালাল। কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পােষণের প্রশ্নই আসে না। কারণ আমরা জানি যে, নিজেদের শক্তি না থাকিলে কেহই আমাদের বন্ধু হইতে আসিবে না। এই দুনিয়া উপযুক্তেরই স্থান এবং আমরা কাহারও করুণার উপর নির্ভরশীল থাকিতে চাই না। আমাদের নিজেদেরই উপযুক্ত হইতে হইবে এবং নিজেদের শক্তিতেই বাঁচিয়া থাকিতে হইবে।
শেখ মুজিব বলেন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল শেরেবাংলা, ও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মত দেশবরেণ্য নেতাকেও বিভেদ সৃষ্টিকারী বলিয়া সাক্ষ্যদান করিয়াছিল। ইহা একটি অতি পুরাতন শ্লোগান। উহা আমরা পরােয়া করি না। তবে আমরা জানি, কিভাবে দাবী-দাওয়া স্বীকার করিয়া লইতে তাহাদের বাধ্য করা যায়।
তুমুল করতালির মধ্যে শেখ মুজিব দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আমরা যে, সংগ্রাম শুরু করিয়াছি জীবনের বিনিময়ে হইলেও আমরা এই সংগ্রাম চালাইয়া যাইব।
৬-দফা দাবীর বিস্তারিত ব্যাখ্যাদান করিয়া শেখ মুজিবর রহমান বলেন, একদা লাহােরে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল। আর পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইবে, এই আশা লইয়া ৬-দফা প্রস্তাব পেশ করার জন্য আমি লাহাের গিয়াছিলাম; কিন্তু আমার সেই আশা ব্যর্থ হইয়াছে।
শেখ মুজিবর রহমান দেশের শিল্প ব্যবস্থার সমালােচনা করিয়া দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করার সুযােগ আসিলে আওয়ামী লীগ দেশের সকল শিল্প জাতীয়করণ করিবে।
রাত ৯টা পর্যন্ত জনসভা
সাধারণতঃ দিনাজপুরের জনসভা মগরেবের পর চালু থাকে না। কিন্তু আজিকার জনসভায় উদ্বেলিত জনতা রাত ৯টা পর্যন্ত সভাস্থলে জমায়েত থাকে। অবশেষে সভার সমাপ্তি ঘােষণার পরও নারাজ জনতা সভার কাজ চালু রাখার এবং আরও বক্তৃতা শ্রবণের দাবী জানাইতে থাকে। কিন্তু রাতেই নেতৃবৃন্দের সড়ক পথে সােয়া দুইশত মাইল পাড়ি দিয়া রাজশাহী রওয়ানা হওয়ার কর্মসূচী থাকায় দিনাজপুরের উদীপ্ত জনতার মূখর আগ্রহকে হতাশ করিতে হয়।
জনসভায় ভাষণদানকালে জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছয় দফার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন যে, ইহা বিগত ১৮ বৎসরের দুর্দশারই বহিঃপ্রকাশ।
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী মাথাভারী শাসন ব্যবস্থার সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, এই মাথাভারী শাসনের দরুন গােটা জাতির জীবনেই দুর্নীতি বিস্তার লাভ করিয়াছে। জনাব চৌধুরী বলেন যে, দেশের উন্নয়নের খাতের ব্যয় কাহারাে ব্যক্তিগত আয় হইতে আসে না, জনগণের সম্পদ হইতেই ইহা সংগৃহীত হয়।
জনাব খােন্দকার মােশতাক আহমদ বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, পাকিস্তান শক্তিশালী করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ সব কিছুই উৎসর্গ করিয়াছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করে নাই।
জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাঁহার বক্তৃতায় স্বাধীনতা সংগ্রামে জনসাধারণ কেন অংশগ্রহণ করিয়াছিল তাহার তাৎপর্য অনুধাবনের আহ্বান জানান। তিনি সরকারের কর নীতির তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি বাধ্যতামূলক লেভীকে নূতন ধরনের ট্যাক্স বলিয়া মন্তব্য করেন। শেখ মুজিবের দিনাজপুর ত্যাগ শেখ মুজিব তাঁহার দলবলসহ রাত দশটায় রাজশাহীর পথে দিনাজপুর ত্যাগ করেন। শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দের সম্মানার্থ এখানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হইয়াছিল। কিন্তু জনসভায় বিলম্বের দরুন এবং অবিলম্বে রাজশাহী রওয়ানা হওয়ার তাগিদে এই অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব