You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
২৮শে মার্চ ১৯৬৬

সন্দ্বীপের বিরাট জনসভায় শেখ মুজিব
শােষণ মুক্তির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিরাপত্তা বাঁধের প্রয়ােজন
(বিশেষ প্রতিনিধি প্রদত্ত)

সন্দ্বীপ, ২৬শে মার্চ।-পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান আজ এখানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় ঘােষণা করেন যে, বঙ্গোপসাগরের বিধ্বংসী গ্রাস আর ভয়াল প্রকৃতির উদ্দামতার হাত হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য দ্বীপাঞ্চলীয় জনসাধারণের যেমন উপকূলীয় বাঁধ অতীব প্রয়ােজন ঠিক তেমনি কায়েমী স্বার্থবাদীদের শােষণীয় হাত হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের একটি নিরাপত্তা বাধের প্রয়ােজন দেখা দিয়াছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের উপর যে সর্বনাশ নামিয়া আসিয়াছে, সেই সর্বনাশের হাত হইতে রেহাই পাওয়ার জন্য এই নিরাপত্তা বাঁধ নির্মাণে আর কালবিলম্ব করা যায় না। এই নিরাপত্তা বাঁধই ৬-দফা।
আজ বেলা আড়াইটায় শেখ মুজিবর রহমান, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী এম, এন, এ, এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এম, এ আজিজ সমভিব্যাহারে জাহাজযােগে সন্দ্বীপ ঘাটে আসিয়া পৌঁছেন। বঙ্গোপসাগরে তখন জোয়ারের উদ্দামতা। তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরের ভয়াল আর্তনাদকে স্তব্ধ করিয়া উপকূলে প্রতীক্ষারত সহস্র সহস্র ছাত্র-জনতা ‘৬-দফা জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করিয়া তােলেন এবং নেতৃবৃন্দকে স্বাগত জানান। উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে শেখ মুজিব সদলবলে একটি সাম্পানযােগে মাঝ দরিয়া হইতে কুলে আসিয়া পৌছিলে শত শত ছাত্রকর্মী নেতৃবৃন্দকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করেন। সাগরের জোয়ারের মত সাগরকূলের মানুষের মধ্যেও যেন জোয়ার জাগিয়া উঠে। জনতা মিছিল করিয়া নেতৃবৃন্দকে শহরে লইয়া যায়। জাহাজঘাট হইতে শহর পর্যন্ত একটানা দুই মাইল পথে মানুষের মিছিল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় নাই। মিছিলে প্রতিজন কর্মীর হাতে ফেষ্টুনের ভাষায় এবং তাদের কণ্ঠে ৬-দফা দাবী আদায়ের দৃঢ় সঙ্কল্পের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিধ্বনি ফুটিয়া উঠে। সন্দ্বীপের মত একটি অবহেলিত দ্বীপের মানুষকেও ৬-দফা যে কতখানি সংগ্রাম মুখর করিয়া তুলিয়াছে তা সম্বর্ধনা মিছিল স্বচক্ষে না দেখিলে অনুমান করা যায় না।
এইদিন নেতৃবৃন্দকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য সন্দ্বীপের ৭টি হাইস্কুলের কোন ছাত্রই ক্লাসে যােগ দেয় নাই। সকাল ১০টা হইতে ছাত্র ও জনতা জাহাজঘাটে আসিয়া ভিড় জমায়। আড়াই লক্ষ লােক অধ্যুষিত সন্দ্বীপের ইতিহাসে শেখ মুজিবের এই সম্বর্ধনা ও তার জনসভা এক ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে।
সাধারণতঃ সন্দ্বীপের যেসব স্থানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, স্থানীয় সরকারী ও আধা-সরকারী কর্তারা তার কোনটাতেই আওয়ামী লীগের জনসভা অনুষ্ঠানের অনুমতি দেন নাই। বাধ্য হইয়া সন্দ্বীপ আওয়ামী লীগ চাষের জমির মধ্যে জনসভার আয়ােজন করেন। চাষের জমিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় সন্দ্বীপের আঠারটি ইউনিয়ন হইতে দলে দলে মানুষ যােগদান করে।
সহস্র সহস্র মানুষের তুমুল হর্ষধ্বনি ও জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান বক্তৃতা করিতে শুরু করেন। সন্দ্বীপবাসীদের কাছে তিনি আওয়ামী লীগের ৬-দফাকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের পটভূমিকায় বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, সাগরের মাঝেই আপনাদের বাস। প্রতিবছর নিষ্ঠুর প্রকৃতি আপনাদের জানমালের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। আপনাদের এবং পরবর্তী বংশধরদের খেয়ালী প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার হাত হইতে বাচাইবার জন্য আপনারা দ্বীপের চতুর্দিকে একটি প্রতিরক্ষা বাঁধের দাবী করিয়াছেন। আপনাদের দাবীর সঙ্গে আমি একমত। বিগত যুদ্ধের সময় দেখা গিয়াছে যে, গােটা পূর্ব পাকিস্তানেই সন্দ্বীপের মত একটি দ্বীপ। সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানেরও কোন সম্পর্ক ছিল না। বিগত ১৮ বত্সর প্রদেশের উপর দিয়া অত্যাচার ও শােষণের ঝঞা বহিয়া গিয়াছে। শােষণ-জর্জরিত পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৫ কোটি মানুষ আজ হৃতসর্বস্ব। দেশের রাজধানীর উপর পূর্ব পাকিস্তানের কোন কর্তৃত্ব নাই, মূলধনের উপর কোন এখতিয়ার নাই; তদুপরি শুধু সামরিক বাহিনীর তিনটি সদর দফতরই পশ্চিম পাকিস্তানে তাই নয়, পূর্ব পাকিস্তানের যথাযােগ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও নাই। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সর্বনাশের হাত হইতে বাঁচাইবার জন্য একটি নিরাপত্তা বাঁধের প্রয়ােজন দেখা দিয়াছে।
শেখ মুজিবর রহমান প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের গৃহযুদ্ধ সম্পর্কিত উক্তিতে গভীর দুঃখ ও বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি জানিতে চান যে, কার বিরুদ্ধে এই গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হইবে। তিনি বলেন, আমাদের সংগ্রাম শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম। তিনি আক্ষেপ করিয়া বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি সনদ ৬-দফার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সকল বিরােধী দলের নেতাও হাত মিলাইয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, পূর্ব পাকিস্তানের এক শ্রেণীর লােক পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থে কোনদিনই এক হইতে পারিলেন না। পূর্ব পাকিস্তানের পলিমাটি হইতে এইসব পরগাছাদের উৎখাত করিতে হইবে। সন্দ্বীপের প্রবীণ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জনাব মুজিবুল হক এম, এ, জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। জনসভায় জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী ও জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী বক্তৃতাদান করেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!