দৈনিক ইত্তেফাক
২১শে মার্চ ১৯৬৬
চরম ত্যাগের প্রস্তুতির বাণী লইয়া দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়ন,
প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানাইয়া দিন-
সর্বস্ব পণ করিয়াই আমরা আজ আন্দোলনের এ কন্টকাকীর্ণ পথে পা বাড়াইয়াছি
– পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিবর রহমান
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
কালবৈশাখীর উদ্দাম নতুন ধূলিঝড় এবং বৃষ্টি সত্ত্বেও গতকাল (রবিবার) পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক এক জনসভার মধ্যদিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে।
প্রকৃতির উদ্দাম তাণ্ডবকে তুচ্ছ করিয়া সভায় সমাগত বিপুল জনস্রোতের উদ্দেশ্যে তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে দৃপ্তকণ্ঠে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সভাপতি ঘােষণা করেন, নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৫ কোটি মানুষের চোখে-মুখে আজ যে বিরাট জিজ্ঞাসা, কুসুমাস্তীর্ণ পথে সে জিজ্ঞাসার জবাব পাইতে হইলে জেল-জুলুম, অত্যাচারনির্যাতনকে আশীর্বাদ বলিয়া বরণ করিতে হইবে। প্রয়ােজন হইলে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্যও প্রস্তুত থাকিতে হইবে। সাড়ে ৫ কোটি মানুষের ভাগ্য ও দেশের দুই অংশের বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতির এই বাণী লইয়া আপনারা দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়ন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানাইয়া দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জানিয়া শুনিয়াই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করিয়া নিয়মতান্ত্রিক পথে ৬-দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য আগাইয়া আসিয়াছে।
সভায় সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান বজ্রকণ্ঠে ঘােষণা করে যে, কঠোর নিয়তান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্যদিয়া আমাদিগকে ৬-দফা দাবী আদায় করিতে হইবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষকে ৬-দফা দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়িয়া তােলার আহ্বান জানান। তিনি ঘােষণা করেন যে, এইবার যদি কোন গণতান্ত্রিক কর্মীর উপর নির্যাতন নামিয়া আসে, তবে পূর্ব পাকিস্তানের সব কয়টি কারাগার আমরা ভরিয়া তুলিব, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করিব। তিনি ঘােষণা করেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক সমঝােতা সৃষ্টি এই দুই প্রদেশের জনসাধারণকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করিয়া গড়িয়া তােলার মধ্যেই পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি নিহিত আছে। গােটা পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের মধ্যে সমঝােতা সৃষ্টি ও তাহাদের সমৃদ্ধি সাধনকল্পেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৬-দফা দাবী উত্থাপন করিয়াছে। বিগত ১৮ বৎসরের বঞ্চনা ও নির্যাতনের আলােকে বিচার করিয়া দেখা গিয়াছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে না পারিলে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৫ কেটি মানুষের বাঁচিবার কোন উপায় নাই।
কেন এই বেইনসাফ
পূর্ব পাকিস্তান দেশের শতকরা ৭৫ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসী বাস করে। তথাপি পূর্ব পাকিস্তানকেই বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকারে পরিণত হইতে হইয়াছে কেন? কেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ইনসাফ করা হয় নাই?
যদি পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের তিন-তিনটি রাজধানী থাকিত, যদি সামরিক বাহিনীর তিনটি সদর দফতরই এখানে থাকিত, যদি দেশের অর্থনেতিক ও বাণিজ্যিক রাজধানী ঢাকায় হইত, যদি বিদেশী কূটনৈতিক মিশনগুলির সদর দফতর এখানে থাকিত, তবে আমরা নয়, ৬-দফার মত দাবী লইয়া সংগ্রাম করিত পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইয়েরা। চিন্তা করিয়া দেখুন । পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের প্রতি ৬-দফা দাবীর যুক্তিযুক্ততা উপলব্ধি করার আহ্বান জানাইয়া শেখ মুজিব বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তান সংগ্রামে কি কোরবানী করিয়াছে, পূর্ব পাকিস্তান দেশের অর্থনীতিতে কি পরিমাণ অর্থ যােগান দেয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সৌহার্দ্য রক্ষার জন্য আমরা স্বাধীনতার পরও রাজনীতিক্ষেত্রে কি কোরবানী দিয়াছি পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের আজ তা গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখা দরকার। তাদের উপলব্ধি করা দরকার যে, কেন্দ্রে আজ একটি মহাশক্তিধর সরকার’ থাকা সত্ত্বেও বিগত যুদ্ধের সময় সে সরকার পূর্ব পাকিস্তানের কোন কাজে আসে নাই।
শক্তিশালী কেন্দ্র থাকিয়া কি লাভ হইল
‘শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান স্বয়ং যুদ্ধের সময় এখানে আসিতে পারেন নাই। পশ্চিম পাকিস্তান হইতে কোনরূপ সাহায্য-সহায়তা এখানে পাঠানাে সম্ভব হয় নাই। জাতির চরম বিপর্যয়ের দিনে আইয়ুব সাহেবের শক্তিশালী সরকার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। এই অভিজ্ঞতার আলােকে সবাইকে গােটা সমস্যাটিকে তলাইয়া দেখিতে হইবে। পাকিস্তানকে সত্যিকারের শক্তিশালী করিতে হইবে। পাকিস্তানের দুইটি হাতকে সমান শক্তিশালী করিতে হইবে। আজ পাকিস্তানের দুইটি হাতের মধ্যে একটি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে আর একটি ফাপিয়া উঠিয়াছে-এই অবস্থাকে শক্তিমান অবস্থা বলা যায় না।
পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষা ব্যবস্থা
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার প্রশ্নে ওয়ারস’তে মার্কিন ও চীনা রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে অনুষ্ঠিত যে আলােচনার কথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব ভুট্টো সম্প্রতি উল্লেখ করিয়াছেন, শেখ মুজিব তার সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য যদি চীন এবং আমেরিকার দিকে তাকাইয়া ও নির্ভর করিয়া থাকিতে হয়, তবে পাকিস্তানের শক্তিশালী কেন্দ্রের আর প্রয়ােজন কি? দেশরক্ষার প্রশ্নে বিদেশী সরকারের উপর নির্ভরশীলতার কথা উল্লেখ করিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার কথাই প্রকাশ করিয়া দিয়াছেন। এই তথ্য প্রকাশের পর পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবক্তাদের প্রতি আর ঈমান আনিবে কিভাবে? শেখ মুজিবর রহমান দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দিয়া বলেন যে, ৬ দফা দাবী আদায়ের জন্য যারা সংগ্রাম করিবে তাদের উপর অত্যাচার আসিবে, নির্যাতন হইবে; কিন্তু এই অত্যাচার আর নির্যাতন সহ্য করিয়া লইয়াও সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত করিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে যে, একদিন সবাইকে মরিতে হইবে। সেই মৃত্যুর আদেশ পরম করুণাময়ের নিকট হইতে আসিবে, ব্যক্তিবিশেষের নিকট হইতে আসিতে পারে না। শেখ সাহেবের বক্তৃতা চলিতে থাকা কালেই বৃষ্টির চাপ বৃদ্ধি পাইতে থাকিলে প্রস্তাবাবলী শ্রবণের পর সভার কাজ শেষ করা হয়।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব