সংবাদ
১৯শে মার্চ ১৯৬৬
আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন শুরু
‘গণদাবী লইয়া সংগ্রাম করিলেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেওয়া হইয়া থাকে
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
পাক-স্বাধীনতাকালে জনগণের নিকটে প্রদত্ত ওয়াদাসমূহের বাস্তবায়ন, গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কায়েম, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান প্রভৃতি গণদাবী স্বাধীনতা উত্তরকালে যখনই পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ হইতে উত্থাপন করা হইয়াছে, তখনই শাসনক্ষমতা কুক্ষিগতকারী কায়েমী স্বার্থীদের পক্ষ হইতে ঢালাওভাবে রাষ্ট্রদ্রোহীতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রচারের অভিযােগ আনয়ন করা হইয়াছে। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমানসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হইয়াছে।
৬-দফা দাবী উত্থাপিত হওয়ায় আজ আবার একই সুরে একই মহল হইতে গালিগালাজ শুরু হইয়াছে।
গতকল্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন উদ্বোধন প্রসঙ্গে জনাব আবদুস সালাম খান উপরােক্ত মন্তব্য করেন। গতকল্য শুক্রবার অপরাহ্ন ৪টায় স্থানীয় ইডেন হােটেলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৩ দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সহিত শুরু হয়। সম্মেলনটি উদ্বোধন করেন ঢাকা জেলা বার সমিতির সভাপতি জনাব আবদুস সালাম খান। উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতা করেন জনাব সালাম খান, করাচী আওয়ামী লীগের সভাপতি মিয়া মঞ্জুরুল হক, সাধারণ সম্পাদক জনাব এ, এইচ, তিরমিজি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবর রহমান, ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব ও ২১-দফার স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধীয় দাবীর ভিত্তিতে ও স্বাধীনতা উত্তর ১৮ বৎসরের অভিজ্ঞতার আলােকে বহুল আলােচিত ৬-দফা দাবীর বিশ্লেষণে লিখিত ভাষণ পাঠ করেন।
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জনাব হাফিজ হাবিবর রহমান সাংগঠনিক রিপাের্ট পেশ করেন।
সম্মেলনে প্রদেশের বিভিন্ন জেলা হইতে সর্বমােট ১,৪৪৩ জন কাউন্সিলর ও ডেলিগেট যােগদান করেন বলিয়া শেখ মুজিবর রহমান জানান।
উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম সালাম খান।
উদ্বোধনী ভাষণে জনাব সালাম খান ৬-দফার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিষােদগারের তীব্র নিন্দা করিয়া বলেন যে, ৬-দফা দাবী ভাবাবেগ প্রসূত নয়। বিগত ১৮ বৎসরে পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে প্রতি সর্বক্ষেত্রে প্রদর্শিত বঞ্চনার ইতিহাসই এই দাবীর যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর ন্যায্য দাবী মানিয়া লইলেই শুধু পাকিস্তানের ঐক্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। পাকিস্তানের সংহতি ও শক্তি কোন শক্তিধর পুরুষের উপর নির্ভরশীল নয়। পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের সন্তুষ্টি ও স্বতােৎসীর সহযােগিতাই রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার নিশ্চয়তা প্রদান করিতে পারে।
৬-দফার দাবীদারদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত প্রেসিডেন্টের বক্তব্যেও অসঙ্গতির প্রতি অঙ্গুলি সঙ্কেত করিয়া তিনি বলেন যে, প্রেসিডেন্ট সাহেব একাধারে বলিতেছেন যে, ৬-দফাওয়ালারা বৃহত্তর বাংলা গঠনের ষড়যন্ত্র করিতেছে… এবং সামরিক শক্তির অধিকারী ভারত কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন হইতে দিবে না।
জনাব সালাম খান বলেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব পূর্বে একাধিকবার বলিয়াছেন যে, যে পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষাব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানে রহিয়াছে বিগত সেপ্টেম্বর যুদ্ধ উক্ত থিওরীর অসারত্ব প্রমাণ করিয়াছে।
তিনি আরও বলেন যে, স্বায়ত্বশাসনের দাবী জনগণের দাবী। কোন স্বৈরশক্তির নিপীড়নই এই দাবীকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে না।
চূড়ান্ত কিছু না
জনাব সালাম খান বলেন যে, ৬-দফার প্রণেতাদের নিকট উহা কোন চূড়ান্ত বিষয় নয়। ৬-দফা সম্পর্ক ক্ষমতাসীনদের সহিত আলােচনার অবকাশ রহিয়াছে।
শেখ মুজিব
৬-দফার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবীরূপে ৬-দফা কর্মসূচী পেশ করিয়াছেন। শান্তভাবে উহার সমালােচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থীদের দালালরা তাঁহার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছে।
অতীতেও রাষ্ট্রভাষার দাবী, ২১-দফা, যুক্ত নির্বাচন ইত্যাদি দাবীর মধ্যে ইহারা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছিল। শেরে বাংলা ফজলুল হক ও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মত নেতাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের উদ্দেশে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, ৬-দফা দাবীর আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। উহা পশ্চিমাংশের ধনীক শ্রেণীর বিরুদ্ধে পরিচালিত। পশ্চিম পাকিস্তানের অগণিত জনসাধারণ অত্যন্ত দরিদ্র। যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসান না হইবে ততদিন ব্যক্তিত্বে ব্যক্তিত্বে এই অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শােষণও বন্ধ করিতে হইবে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব