You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক পাকিস্তান
১লা মার্চ ১৯৬৬

লেভী : ফকির আবদুল মান্নান, শেখ মুজিব ও হাতেম আলী খানের মত
(ষ্টাফ রিপাের্টার)

প্রাদেশিক সরকার পাঁচ একরের বেশী জমিতে আমন ধান্য ফলানাের উপর বাধ্যতামূলক লেভী চাল করার পর হইতে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মচারী চাষীদের উপর নানাপ্রকার অত্যাচার চালাইতেছে বলিয়া প্রদেশের বিভিন্ন স্থান হইতে অভিযােগ পাওয়া যাইতেছে।
উল্লেখযােগ্য যে, প্রদেশের সর্বত্র ধান ও চাউল সুষ্ঠুভাবে বিতরণের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সরকার এই লেভী প্রথা চালু করিয়াছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মচারীদের অকর্মণ্যতা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দলাদলীর ফলে বর্তমানে এই ব্যবস্থা সাধারণ কৃষকদের জীবনে একটি ‘বিপদ’ রূপে দেখা দিয়াছে বলিয়া অনেকে অভিযােগ করেন।
লেভী সংক্রান্ত বিভিন্ন স্থান লইতে প্রাপ্ত অভাব-অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে “দৈনিক পাকিস্তানের এই প্রতিনিধি প্রকৃত অবস্থা পর্যালােচনার জন্য খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী জনাব ফকির আবদুল মান্নান, কৃষক নেতা জনাব হাতেম আলী খান ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবার রহমানের সহিত সাক্ষাৎ করেন। শেখ মুজিবর রহমানো মতে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায় খাদ্য ঘাটতি এলাকায় কখনও বাধ্যতামূলক লেভী প্রথা চালু করা উচিত নয়।
জনাব হাতেম আলী খান বলেন যে, বর্তমানে যাহাদের মাত্র ২/৩ একর জমি রহিয়াছে, তাহাদের নিকট হইতেও এই লেভী আদায় করা হইতেছে।
খাদ্যমন্ত্রী জনাব ফকির আবদুল মান্নান বলেন যে, কৃষকদের সকল প্রকার অভাব-অভিযােগের প্রতি সরকার বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করিয়া সংশােধনের ব্যবস্থা করিতেছেন।
এই সম্পর্কে উপরােক্ত তিনজন নেতার বক্তব্যের বিস্তারিত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইলঃ
ফকির আবদুল মান্নান
সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান সম্পর্কে প্রাদেশিক খাদ্যমন্ত্রী ফকির আবদুল মান্নান এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, লেভীর ব্যাপারে কৃষকদের দুঃখকষ্ট লাঘব ও অভাব-অভিযােগ দূর করার জন্য তাহাদের আবেদনের নিয়মিত শুনানী হইতেছে এবং কোথায়ও ত্রুটিবিচ্যুত দেখা গেলে উহা সংশােধনেরও ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
পশ্চাভূমিতে ৫ একরের অতিরিক্ত জমিতে আমন চাষকারী কৃষকের নিকট হইতে একর প্রতি ৪ মণ হারে ধান্য সংগ্রহের ব্যাপারে যে সমস্ত অভিযােগ পাওয়া যাইতেছে সে সম্পর্কে তদন্ত করা হইতেছে বলিয়া খাদ্যমন্ত্রী জানান। খাদ্যমন্ত্রী আরও জানান যে, ৫ একরের বেশী জমিতে আমন বুনা সত্ত্বেও যদি কাহারও ফসল কম উৎপন্ন হইয়া থাকে বা ৫ একরের বেশী আমনের জমি থাকা সত্ত্বেও পরিবারের লােকসংখ্যার তুলনায় উৎপন্ন ফসল পর্যাপ্ত নহে, এরূপ পরিবারকে লেভী হইতে রেহাই দেওয়ার জন্য সরকার ডেপুটি কমিশনারদের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করিয়াছেন।
বর্তমানে খােলা বাজারে ধান ২০ টাকা হইতে ২২ টাকা মণদরে বিক্রয় হইতেছে এবং সেই তুলনায় চাষীদের মণপ্রতি ১৩ টাকা ৫০ পয়সা প্রদান খুবই কম বলিয়া বিভিন্ন মহলের অভিযােগ সম্পর্কে ফকির আবদুল মান্নান বলেন, বিগত ১২ বৎসরে ধানের মূল্যের গড় বিবেচনা করিয়া এই মূল্যকে অন্যায় বলা চলে না।
সীমান্ত এলাকার ৫ মাইলের মধ্যে চাষীদের মাথাপিছু ৯ মণ আমন ধান রাখার যে বিধান করা হইয়াছে তাহাতে গতরখাটা কৃষকদের খােরাকী চলিবে
বলিয়া বিভিন্ন মহলের অভিমত সম্পর্কে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ীই একজন লােকের বাৎসরিক খােরাকী বাবদ ৯ মণ ধান্য ধরা হইয়াছে। তবে ভবিষ্যতে এই বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা করা হইবে এবং উহা বিবেচনার দাবী রাখে। মাপ ও মূল্য পরিশােধ সংক্রান্ত অভিযােগ সম্পর্কে সরকারী গুদামে ধান জমা দেওয়া ও মাপের ব্যাপারে ত্রুটি এবং মূল্য পরিশােধে অযথা হয়রানির অভিযােগ সম্পর্কে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারী গুদামের দুই মাইলের মধ্যে যাহারা অবস্থিত তাহারা গুদামে ধান জমা দিয়া থাকে। এছাড়া দূরবর্তী এলাকার জন্য অনুমােদিত সরকারী ডিলার নিয়ােগ করা হইয়াছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নগদ মূল্য পরিশােধ করা হয়। মাপ সম্পর্কে তিনি বলেন, এরূপ দেখা গিয়াছে যে, চাষীরা ধানে বালি মিশাইয়া ও পানি ছিটাইয়া উহার ওজন বাড়াইবার কৃত্রিমপন্থা অবলম্বন করিতেছে। এসব ক্ষেত্রে মাপে কিছু কম ধরা ছাড়া উপায় নাই। তিনি আরও জানান যে, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী, এমপিএ, এম এনএ এবং সংশ্লিষ্ট কমিটি প্রায়ই ধান্য ক্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করিয়া থাকেন। কাজেই ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটার তেমন কোন অবকাশ নাই।
লেভী সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, খাদ্য ঘাটতি এলাকায় বাধ্যতামূলক। লেভী কখনও চলিতে পারে না।
তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান খাদ্য উৎপাদনের দিক দিয়া সরকারীভাবে স্বীকৃত একটি ঘাটতি এলাকা। কোন কোন এলাকায় যদি ফসল বেশী উৎপাদন হয় তবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জনসাধারণ ঐ বাড়তি শস্য ক্রয় করিয়া নিজেদের চাহিদা মিটায় অথবা উদ্বৃত্ত এলাকায় কাজকর্ম করিয়া খাইয়া বাঁচে।
শেখ মুজিবর রহমান বলেন, “সরকারের পূর্ণ লেভীর ফলে বহু খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। পশ্চাভূমি হইতে যে চাষী ৫ একরের বেশী জমিতে আমনধান বুনিয়াছে সেই সমস্ত এলাকায় ৫ একরের অতিরিক্ত জমি হইতে প্রতি একরে ৪ মণ করিয়া ধান সরকারী গুদামে জমা দেওয়ার ব্যবস্থার সমালােচনা করিয়া আওয়ামী লীগ সম্পাদক বলেন, এই ব্যবস্থা গ্রহণের বেলায় সরকার চাষীর পরিবারের লােক সংখ্যার কথা বিবেচনা করেন নাই।”
তিনি অভিযােগ করেন যে, থানার সরকারী গুদামে শস্য জমা দেওয়ার ব্যাপারেও চাষীদের হয়রানি পােহাইতে হয় বলিয়া তিনি অভিযােগ করেন।
সরকার এ পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা হইতে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করিয়াছেন তাহা ঐ সমস্ত এলাকায় সংশােধিত রেশনিং-এর মাধ্যমে বিক্রয় করার দাবী জানান।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!