You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.02.22 | শেখ মুজিবের ৬-দফা দাবীর প্রতি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অকুণ্ঠ সমর্থন | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
২২শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬

শেখ মুজিবের ৬-দফা দাবীর প্রতি
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অকুণ্ঠ সমর্থন
(স্টাফ রিপাের্টার)

পাক-ভারত মধ্যকার সশস্ত্র সংঘর্ষ, যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এই সংঘর্ষের অবসান, তাসখেন্দ চুক্তি এবং সম্প্রতি অনুষ্ঠিত লাহাের সম্মেলনের পটভূমিকায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠক গত রবিবার অধিক রাত্রে সমাপ্ত হয়। ওয়ার্কিং কমিটির এই বর্ধিত বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন ও আনুষ্ঠানিক অনুমােদন দান করা হয়। বৈঠকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চুলচেরা পর্যালােচনা করা হয়। ওয়ার্কিং কমিটির এই বর্ধিত সভা তাসখেন্দ ঘােষণাপত্র সম্পর্কে দলীয় অভিমত ব্যক্ত করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে জরুরী অবস্থার আশু অবসান ঘটাইয়া দেশবাসীকে তাঁহাদের হৃত মৌলিক অধিকার ফিরাইয়া দেওয়ার, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন ও তৎসংক্রান্ত বিধিবিধান বাতিল করার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুন্নকারী বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জোর দাবী জানাইয়াছে।
গত রবিবার সকাল ৯টায় শেখ মুজিবর রহমানের ধানমণ্ডীস্থ বাসভবনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই বর্ধিত বৈঠক শুরু হয়। যুদ্ধোত্তরকালে দেশে উদ্ভূত সম্পূর্ণ নূতন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেশবাসীকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার সঠিক পথ নির্দেশদান করাই এই বৈঠক অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছাড়া জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকেরাও বিশেষ দায়িত্ব ও আগ্রহ সহকারে বিশেষ আমন্ত্রণক্রমে এই বৈঠকে যােগদান করেন। প্রায় পনের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে যােগদানকারী সদস্যবৃন্দ দেশের যাবতীয় প্রশ্নে তাহাদের ও সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীদের মতামত ব্যক্ত করেন। বৈঠকের শুরুতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর মৃত্যুতে শােক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অসুস্থ সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের আশু রােগমুক্তি কামনা করা হয়। তারপর পূর্ব পাক আওয়ামী লীগের সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে গৃহীত দলীয় ব্যবস্থাদি বিশেষ করিয়া ঢাকায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকার এবং সাম্প্রতিক লাহাের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের যােগদান ও সম্মেলনের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্কচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়ে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে যােগদানকারীদের অবহিত করান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠক শেখ মুজিবের বিগত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাপ্রসূত ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করিয়াছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এই ৬দফাকে অনুমােদন দান করিয়াছে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্বলিত আওয়ামী লীগের এই ৬-দফার দলীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহকারে পুস্তিকা প্রকাশ করিয়া ঐসব পুস্তিকা দেশবাসীর মধ্যে বিতরণ করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়। পুস্তিকার খসড়াও প্রকাশের জন্য ৬-সদস্য বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হইয়াছে। বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও হাইকোর্ট বার সমিতির সভাপতি জনাব আবদুস সালাম খান, শেখ মুজিবর রহমান, জনাব জহিরউদ্দীন, জনাব তাজুদ্দীন আহমদ, হাফেজ হাবিবুর রহমান এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব মুজিবর রহমান এই কমিটির সদস্য হিসাবে মনােনীত হইয়াছেন।
তাসখেন্দ ঘােষণাপত্র সম্পর্কেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সুস্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। তাসখেন্দ ঘােষণাপত্র সম্পর্কে মতামত দান প্রসঙ্গে গৃহীত প্রস্তাবে দেশে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম রাখা এবং এই ধরনের ব্যবস্থা কায়েম রাখার ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন পরিস্থিতির তীব্র সমালােচনা করা হয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার দোষ-ত্রুটি ও বিপদআপদ হইতে দেশ ও দেশবাসীকে অব্যাহতি দানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগ বর্তমান শাসনতান্ত্রিক ও অপ্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থার অবসান করতঃ জনসাধারণের ইচ্ছাকে সার্বিক প্রাধান্য দিয়া দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের জোর দাবী জানাইয়াছেন। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বহু বিঘােষিত নীতির পুনরােল্লেখ করিয়া ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, আওয়ামী লীগ বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাস করে এবং বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে বিশেষ করিয়া তাহাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে শান্তি ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করিতে চায়। বিশ্বের সাধারণ মানুষ বিশেষ করিয়া আমাদের মত অনুন্নত দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও প্রগতির স্বার্থে সকল আন্তর্জাতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। তাসখেন্দ ঘােষণাপত্র প্রসঙ্গে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, তাসখেন্দ ঘােষণাপত্রে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কার্যকর নাও হইতে পারে বলিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি মনে করে। পাক-ভারতের মধ্যকার কাশ্মীরসহ সকল সমস্যা সমাধানকল্পে দুই দেশই তাসখেন্দ ঘােষণাপত্রকে উহার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যমতে কার্যকরী করার প্রয়াস পাইবে বলিয়া ওয়ার্কিং কমিটি আশাবাদ প্রকাশ করিয়াছে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব