You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.02.27 | দেশবাসী যাহাতে স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ ভােগ করিতে পারে- আওয়ামী লীগের ৬-দফা দেশবাসীর ঈপ্সিত সেই শক্তিশালী পাকিস্তানেরই সুস্পষ্ট রূপরেখা | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
২৭শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬

দেশবাসী যাহাতে স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ ভােগ করিতে পারে-
আওয়ামী লীগের ৬-দফা দেশবাসীর ঈপ্সিত সেই
শক্তিশালী পাকিস্তানেরই সুস্পষ্ট রূপরেখা
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কর্মী সমাবেশে শেখ মুজিবের বক্তৃতাঃ
দলীয় কর্মসূচীর ‘কি ও কেন ব্যাখ্যা
(ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি)

চট্টগ্রাম, ২৬শে ফেব্রুয়ারী, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নহে, শক্তিশালী পাকিস্তানই ছিল দেশবাসীর বরাবরের কাম্য। স্বার্থান্বেষী মহলের শাঠ্য ও চক্রান্তের মারপ্যাচে জনগণের সেই কামনা বরাবরই স্তিমিত হইয়া পড়িয়াছে। এবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধে দেশবাসী যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছে, সেই সাক্ষাৎ-অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই দেশবাসী আজ নূতন করিয়া অনুধাবন করিয়াছে যে, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নহে কেবলমাত্র শক্তিশালী পাকিস্তানই পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের নিবিড় ঐক্য ও সংহতির একমাত্র রক্ষাকবচ। আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচী প্রকৃত প্রস্তাবে দেশবাসী জনসাধারণের ঈপ্সিত সেই শক্তিশালী পাকিস্তানেরই সুস্পষ্ট রূপরেখা। রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে এই রূপরেখার বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগের ৬-দফার দাবী লইয়া গ্রামে গ্রামে আপনারা ছড়াইয়া পড়ন।” -অদ্য স্থানীয় জে, এস, সেন হলে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলন ও কাউন্সিল সভায় সমাগত সহস্রাধিক আওয়ামী লীগ কর্মীর উদ্দেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান এই উদাত্ত আহ্বান জানান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেনঃ অতীতের মত ভবিষ্যতেও গণতন্ত্রকে যাতে কায়েমী স্বার্থের শিকারে পর্যবসিত হইতে না হয়, দেশবাসীকে যাতে গণতন্ত্র কায়েম থাকা অবস্থায়ও মহল বিশেষের অনুগ্রহ বা অনুকম্পার উপর নির্ভর করিতে না হয়। গণতন্ত্র মতে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে যাতে ব্যক্তি বা গােষ্ঠী বিশেষ নিজের বা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য খতম করিতে না পারে, সর্বোপরি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হইলে দেশবাসী যাতে অনন্তকাল ধরিয়া স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ জীবনের সর্বস্তরে ভােগ করিতে পারে তার জন্যই আওয়ামী লীগ গত ১৮ বৎসরের শাসন ও শােষণের, নির্যাতন ও বঞ্চনার আলােকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬-দফা প্রণয়ন করিয়াছে।
আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কি?
শেখ মুজিবর রহমান বলেনঃ এ যাবৎ আমরা পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলিয়াছি, কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের এই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীর তাৎপর্য বা অন্তর্নিহিত লক্ষ্য সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের এবং পূর্ব পাকিস্তানের কোন কোন নেতা কোনদিন আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। তাই, আজ আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য ৬-দফার মধ্যদিয়া স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিয়াছি যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে আমরা কি বুঝি। দেশবাসীকে কেবল ধোঁকা দিবার নিমিত্ত আজও যারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ফাকা শ্লোগান তােলেন, তাঁদের বুঝা উচিত যে, ফাঁকা বুলির যুগ শেষ হইয়াছে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে তারা কি বােঝেন বা বুঝাইতে চাহেন, আওয়ামী লীগের ৬-দফার পাশাপাশি দফা-ওয়ারীভাবে আজ তাহাদিগকে তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে হইবে। যদি তাহারা তাহা না করেন, তাহা হইলে তাহাদের কথাকে দেশবাসী রাজনৈতিক কারচুপি এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ভাঁওতা দেওয়ার আরেক দফা নূতন প্রয়াস বলিয়া গণ্য করিবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, জেলার দূরবর্তী এলাকা হইতে আগত এক সহস্রাধিক সঙ্কল্পদৃঢ় আওয়ামী লীগ কর্মীর সমাবেশে শেখ সাহেব বক্তৃতা করিতেছিলেন।
বৈষম্যের প্রশ্নে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের লইয়া কমিশন গঠনের দাবী
শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, বর্তমান শাসনতন্ত্রে দুই প্রদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য স্বীকার এবং উহা দূরীকরণের অঙ্গীকার করা হইলেও বাস্তবক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস পাইতেছে না। তিনি বলেন যে, বর্তমানে বরং অধিকতর নৈপুণ্যের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাইতেছে। শেখ মুজিব বলেন যে, স্বাভাবিকতার কদর থাকিলে তিনি এ ব্যাপারে তদন্ত কমিশনই দাবী করিতেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন কমিশনের রিপাের্ট যেভাবে দিবালােকের মুখ দেখিবার মওকা পায় না, এবং এই সেদিনও ঈদের চাঁদ সংক্রান্ত ব্যাপারে গঠিত কমিটির ৭ দিনের মধ্যে রিপাের্ট পেশের ব্যাপারটিও যেভাবে ধামাচাপা পড়িয়াছে। তাহাতে তিনি আর তদন্ত কমিশন দাবী করেন না। তৎপরিবর্তে তিনি জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের লইয়া একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করিয়া দুই তদন্ত কমিশন দাবী করেন না। তৎপরিবর্তে তিনি জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের লইয়া একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করিয়া দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের হিসাব করার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের নিকট দাবী জানানই বাঞ্ছনীয় মনে করেন।
অন্যান্য দল সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতি
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতি আওয়ামী লীগের নীতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, যেসব দল ৬-দফায় বর্ণিত দাবী-দাওয়ার স্বীকৃতি দিবেন, সেইসব দলের সঙ্গে সহযােগিতা করিতে আওয়ামী লীগ সর্বদাই প্রস্তুত। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং অন্যান্য দাবী পূরণের ব্যাপারে অপর কোন রাজনৈতিক দল আমাদের এই ৬-দফা অপেক্ষাও উন্নত কোন প্রস্তাব পেশ করিতে পারিলে আওয়ামী লীগ সানন্দে তাহা বিবেচনা করিতে প্রস্তুত বলিয়া শেখ মুজিব ঘােষণা করেন। তিনি ঘরে ঘরে ৬-দফার বাণী পৌছাইয়া দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
খােন্দকার মােশতাক আহমদ
সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা খােন্দকার মােশতাক আহমদ বলেন যে, ৬-দফার সংগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের শেষ সংগ্রাম। সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য তিনি প্রতিযােগিতার ভিত্তিতে ত্যাগ স্বীকার করার জন্য কর্মীদের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন যে, বঞ্চিত মানুষ বেদনা বােধ করিলেও তা প্রকাশের শক্তি তাহাদের নাই। বেদনাকাতর সাধারণ মানুষের মুখপাত্র হিসাবে আওয়ামী লীগ কর্মিগণকেই আজ দেশবাসী জনসাধারণের সত্যিকার দাবী-দাওয়া তুলিয়া ধরিতে হইবে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।
সংকল্প সাধনের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা লইয়া আগাইয়া আসুন
খােন্দকার মােশতাক আহমদ দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দেন যে, অতীতে স্বার্থান্বেষী মহল পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ চক্রান্তে লিপ্ত থাকিয়া প্রদেশবাসী জনসাধারণের আশা-আকাংক্ষা নস্যাৎ করিয়া দিয়াছে। এবারও যখন পূর্ব পাকিস্তানের দাবী-দাওয়া প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তখন আবার রাজনৈতিক গগনে সেই একই চক্রান্তের ঘনঘটা দেখা দিয়াছে এবং চক্রান্তকারীরা নানা ছদ্মবেশে তৎপর হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। তিনি চক্রান্তকারীদের সে চক্রান্তকে ব্যর্থ করিয়া ৬-দফাকে সফল করার জন্য দলীয় শৃংখলা বজায় রাখিতে এবং কর্মীদের ইস্পাত-কঠিত দৃঢ়তা লইয়া সেনাবাহিনীর মতই কর্তব্য সাধনে অবিচল সংকল্পবদ্ধ থাকিবার জন্য কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। সম্মেলনে জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিশদ বিবরণ দেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সংঘের প্রাক্তন সভাপতি জনাব মােহাম্মদ ইদ্রিস বলেন যে, মরহুম সােহরাওয়ার্দীর মাত্র ১৩ মাসব্যাপী প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে শিল্পকে প্রাদেশিক বিষয় করার ফলেই আজকাল শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে দুইচারিজন বাঙ্গালী দৃষ্ট হয়। সম্মেলনে ডাঃ সৈয়দুর রহমান ও জনাব আবদুল্লাহ আল-হারুণও বক্তৃতা করেন। চট্টগ্রাম চারণ কবি জনাব মােহাম্মদ শফি ৬-দফার উপর রচিত কবিতা সম্মেলনে পাঠ করিয়া শুনান। উক্ত চারণ কবি, লালদীঘির গত শুক্রবারের জনসভায়ও ৬-দফাভিত্তিক গান পরিবেশন করেন। জনাব শফি’র গানে সন্তুষ্ট হইয়া শেখ মুজিবর রহমান তাহাকে ৫০ টাকা পুরস্কার দেন।
মাইজদী যাত্রা
চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সম্মেলন শেষে শেখ মুজিবর রহমান অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা সমভিব্যাহারে আগামীকল্য ভােরে মাইজদী রওয়ানা হইতেছেন। অদ্য (রবিবার) সকালে তিনি মাইজদী কোর্টে নােয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সম্মেলনে যােগদান করিবেন এবং বিকালে বেগমগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা করিবেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব