You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬

কাউন্সিল লীগ নেতারা আবার কি বলেন…
(ষ্টাফ রিপাের্টার)

পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ও জাতীয় পরিষদ সদস্য খাজা খয়েরউদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব এ, কিউ, এম, শফিকুল ইসলাম গত মঙ্গলবার ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব বাস্তবধর্মী নয় এবং আজ এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ অচল। তাহারা বলেন যে, লাহাের প্রস্তাবে ‘দুই পাকিস্তানের সম্ভাবনা দৃষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির অর্ধেক বাংলা আর আসাম বাদ দিয়া যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাতে ‘এক পাকিস্তান সম্ভব, লাহাের প্রস্তাব মতে “দুই পাকিস্তান সম্ভব নয়। তাহারা আরও বলেন যে, যদি পূর্ব বাংলা এবং আসাম লইয়া পাকিস্তানের এই অংশ” গঠিত হইত, তবে তাঁহারা লাহাের প্রস্তাব মানিতে প্রস্তুত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবী করিয়া সাম্প্রতিক লাহাের সম্মেলনে যে ৬-দফা সুপারিশ করিয়াছেন, প্রধানতঃ সেই ৬-দফা সম্পর্কে ব্যক্তিগত ও দলীয় মতামত দেওয়ার জন্যই কাউন্সিল মুসলিম লীগের উপরােক্ত দুই নেতা এই সাংবাদিক সম্মেলনের অনুষ্ঠান করেন।
জনাব খাজা খয়েরউদ্দিন এবং জনাব শফিকুল ইসলাম শেখ মুজিবের ৬-দফাকে ‘ভয়াবহ পরিণতি সম্পন্ন এবং পাকিস্তানের সংহতির জন্য মারাত্মক’ বলিয়া বর্ণনা করেন। তাঁহারা বলেন যে, যদিও শেখ মুজিবর রহমান তাঁহার ৬-দফায় ফেডারেশনের কথা বলিয়াছেন; কিন্তু তিনি যেসব শর্ত আরােপ করিয়াছেন, তাহাতে আসলে কনফেডারেশনের কথাই বলিতে চাহিয়াছেন। কারণ, যে লাহাের প্রস্তাবকে ভিত্তি করিয়া শেখ মুজিব সুপারিশ করিয়াছেন, তাহাতে ফেডারেশনের ইউনিটসমূহের “স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম” হওয়ারই কথা ছিল। তাঁহারা বলেন যে, শেখ মুজিবর রহমান তাঁহার ৬-দফায় দেশরক্ষা ও কর ধার্য সম্পর্কে যে সুপারিশ করিয়াছেন, তাহাতে দেশের ‘সংহতি বিনষ্ট হওয়ার আশংকা আছে। তাহাদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করিতে বলা হইলে তাহারা বলেন যে, তাঁহারাও আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের দাবীদার, তবে তাহা কেন্দ্রীয় দেশরক্ষা দফতরের অধীনে থাকিতে হইবে। শেখ মুজিবের সুপারিশকৃত প্যারা-মিলিটারী বা আঞ্চলিক সামরিক বাহিনী আজও আছে বলিয়া তাহাদের স্মরণ করাইয়া দিলে তাহারা বলেন যে, বর্তমানে যে ই, পি, আর, আছে, বর্তমান ব্যবস্থায় দেশরক্ষার কাজে ব্যাপৃত থাকিলে উহাকে দেশরক্ষা বিভাগের অধীন করা হয়। তাঁহারা এই পর্যায়ে বলেন যে, শেখ মুজিব তাঁর সুপারিশে দেশরক্ষা বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থায় প্যারা-মিলিটারী আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের সুপারিশ করিয়াছেন বলিয়া তাহারা মনে করেন এবং কাউন্সিল লীগ এই প্রথার বিরােধী।
শেখ মুজিব ফেডারেশনের ইউনিটসমূহের জন্য কর ধার্য করার সার্বিক ক্ষমতা বিধানের যে সুপারিশ করিয়াছেন, কাউন্সিল লীগ নেতৃদ্বয় তারও বিরােধিতা করেন। তারা বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় বহনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকার বা ফেডারেশনের ইউনিটসমূহের মুখাপেক্ষী হইতে পারেন না। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কর ধার্য করার এখতিয়ার অবশ্যই থাকিতে হইবে। এই পর্যায়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জনাব শফিকুল ইসলাম বলেন যে, কাউন্সিল মুসলিম লীগও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষপাতী। কি ধরনের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন তিনি বা তাহার দল চান,তাহা জানিতে চাহিলে তিনি বলেন যে, আপােষক্রমে নির্ধারিত সর্বাধিক ‘বিষয়’ প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারে থাকিবে এবং ন্যূনতম সংখ্যক বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারে এখতিয়ারে থাকিবে। কি কি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকিবে, সেই সম্পর্কে কাউন্সিল লীগ দল হিসাবে আজও কোন সিদ্ধান্ত নেয় নাই বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। তবে তিনি নিজে মনে করেন যে, দেশরক্ষা, মুদ্রা এবং পররাষ্ট্র (বিদেশী বাণিজ্যসহ) এই বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকা উচিত।
এই পর্যায়ে জনৈক সাংবাদিক বিদেশী বাণিজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছাড়িয়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাট সংক্রান্ত বিদেশী বাণিজ্যও কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে ছাড়িয়া দেওয়া হইবে কি-না জানিতে চাহিলে জনাব শফিকুল ইসলাম বলেন যে, তাঁহার মতে পাট সংক্রান্ত বৈদেশিক বাণিজ্যও কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছাড়িয়া দিতে হইবে।
কাউন্সিল মুসলিম লীগ দেশের জন্য কি ধরনের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিতে চান, তাহা জানিতে চাহিলে জনাব শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব তাঁহাদের স্কন্ধে অর্পিত হইলে তাহারা সে সম্বন্ধে ভাবিয়া দেখিবেন, এক্ষণে সেই সম্বন্ধে দলীয়ভাবে তাঁহারা কিছু ঠিক করেন নাই।
সাম্প্রতিক লাহাের সম্মেলনে শেখ মুজিবের ৬-দফা সুপারিশ উত্থাপন প্রসঙ্গে জনাব শফিকুল ইসলাম বলেন যে, শেখ মুজিব তাঁহার ৬-দফা সুপারিশ দলীয় প্রধানদের কাছে বিলি করেন। তিনি সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটির একটি অধিবেশনে যােগদান করেন; কিন্তু অবশিষ্ট অধিবেশনসমূহে যােগদান করেন নাই। কেন তিনি অবশিষ্ট অধিবেশনে যােগদান করিলেন না, সেই সম্পর্কে জনাব ইসলাম কিছু জানেন না বলিয়া উল্লেখ করেন।
খাজা খয়েরউদ্দিন ও জনাব শফিকুল ইসলাম বিভিন্ন মহল হইতে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী উত্থাপন করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁহারা বলেন যে, লাহাের প্রস্তাব গ্রহণের পর বিভিন্ন সময়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ অন্যান্য বহু প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তের দ্বারা লাহাের প্রস্তাবকে হয় সংশােধন করিয়াছে, নয় ঐ প্রস্তাবের সিদ্ধান্তকে অতিক্রম করিয়া নূতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে। এইসব ‘অন্যান্য সিদ্ধান্ত কি এবং কোথায় গৃহীত হইয়াছে, তাহা জানিতে চাহিলে জনাব শফিকুল ইসলাম বলেন যে, ১৯৪৬ সনে দিল্লীতে মুসলিম লীগ লেজিসলেটরস কনভেনশনে এবং স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রাক্কালে মুসলিম লীগের শেষ কাউন্সিল অধিবেশনে নয়া সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এইসব সিদ্ধান্তে ‘দুই পাকিস্তানের স্থলে’ ‘এক পাকিস্তানের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়া নেওয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে জনাব ইসলাম বলেন যে, আলােচ্য কনভেনশন ও কাউন্সিলে লাহাের প্রস্তাবের উল্লেখ করিয়া উহার পরিপন্থী বা উহার ‘নিন্দা করিয়া নূতন কোন প্রস্তাব গৃহীত হয় নাই। তাঁহারা বলেন যে, আজ লাহাের প্রস্তাবের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ, যে ভৌগােলিক এলাকা লইয়া পাকিস্তান গঠিত হওয়ার কথা। ছিল, সেই এলাকা লইয়া পাকিস্তান গঠিত হয় নাই আর যেভাবে পাকিস্তান গঠিত হইয়াছে, তাহাতে লাহাের প্রস্তাবে বর্ণিত ‘দুই পাকিস্তানের চাইতে ‘এক পাকিস্তান বজায় রাখাই উত্তম।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!