দৈনিক ইত্তেফাক
৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬
এই অবস্থার অবসান ঘটাইয়া জনগণের ইচ্ছানুযায়ী
দেশের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করিতে হইবে
লাহাের সম্মেলনে যােগদানের কারণ ব্যাখ্যা প্রসংগে শেখ মুজিবর রহমান
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (শুক্রবার) লাহােরে জাতীয় সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান দেশের যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি ভাবাবেগমুক্ত পরিবেশে বিবেচনা ও বিগত রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ করিয়া স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও নিষ্কলুষ মন লইয়া ভবিষ্যতের পথে দৃঢ় পদক্ষেপ করার প্রয়ােজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। লাহােরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে গতকল্য তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক শেখ মুজিবর রহমানকে ঘিরিয়া ধরেন। শেখ মুজিবর সাংবাদিকদের একটি স্বাক্ষরিত ভাষণদান করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, এই মুহূর্তে তাঁহার এর বেশী কিছু বলার নাই। শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেন যে, আগামীকল্য লাহােরে যে জাতীয় সম্মেলন শুরু হইতেছে, তাহাতে যােগদানের জন্যই তিনি ও তাঁহার সহকর্মীরা লাহাের যাইতেছেন। তিনি বলেন যে, ভারতের সহিত সাম্প্রতিক যুদ্ধের ফলে দেশ আজ ক্ষতবিক্ষত। তাই সামগ্রিকভাবে দেশের পরিস্থিতি আজ ধীরস্থিরভাবে বিবেচনা করিতে হইবে। বিগত রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দেনাপাওনার হিসাব আজ কষিয়া দেখিতে হইবে এবং এই হিসাবের প্রেক্ষিতে দেশ আজ সার্বিকভাবে কি পাইয়াছে তাহাও বিচার-বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে। আওয়ামী লীগের নীতি প্রসঙ্গে শেখ মুজিব ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ সর্বত্রই শান্তির পক্ষপাতী। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা শান্তিতে বসবাস করিতে চাই। আওয়ামী লীগ সর্বপ্রকারের আন্তর্জাতিক বিরােধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে বিশ্বাসী এবং বিরােধ মীমাংসার জন্য শক্তির ব্যবহারকে আওয়ামী লীগ নিন্দা করে। শান্তিকে সমুন্নত রাখার সুস্পষ্ট ব্রত লইয়াই আমরা প্রস্তাবিত লাহাের সম্মেলনে যােগদান করিতেছি। শান্তিকামী মানুষের চাপে বিশেষ করিয়া রুশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ কসিগিনের প্রচেষ্টায় আজ যে স্বস্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে। তাহাকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাইবার জন্যও আমরা জাতীয় সম্মেলনে যােগদান করিতেছি। শান্তির উপর যে কোন ধরনের ভাবী হামলা প্রতিরােধের ব্যাপারে আমাদের সদা সজাগ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। শেখ মুজিব বলেন যে, সাম্প্রতিককালে উপর্যুপরি পটপরিবর্তনে ইহাই প্রতিভাত হইয়াছে যে, ব্যক্তির খেয়ালখুশী অনুযায়ী নহে, সমষ্টির বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ীই দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খ প্রতিফলিত করার জন্য নির্ভেজাল গণতন্ত্র পুনরায় কায়েম করিতে হইবে। বিগত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা হইতে আজ সকলেই পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশীভাবে উপলব্ধি করিয়াছেন যে, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতান্ত্রিক শর্তানুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও দেশ রক্ষামূলক বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্ননির্ভরশীল করার দ্বারাই দেশের অখণ্ডতা ও সংহতি বজায় রাখা সম্ভব। শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব তাজুদ্দিন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং প্রাদেশিক পরিষদে বিরােধী দলের নেতা জনাব আবদুল মালেক লাহাের গমন করেন। জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের অপর দুইজন সদস্য প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাফিজ হাবিবুর রহমান ও জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সদস্য জনাব এ, বি, এম, নূরুল ইসলাম ইতিপূর্বে লাহাের গিয়া পৌছিয়াছেন। গতকল্য বিমানবন্দরে সিটি আওয়ামী লীগের সম্পাদক গাজী গােলাম মুস্তফা বিপুলসংখ্যক কর্মীসহ নেতৃবৃন্দকে বিদায় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। আগামী ৯ই ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিবর রহমান সদলবলে লাহাের হইতে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিবেন বলিয়া আশা করা যাচ্ছে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব