সংবাদ
৬ই ডিসেম্বর ১৯৬৫
সােহরাওয়ার্দী মৃত্যুবার্ষিকীর শপথ
গণতান্ত্রিক আদর্শের শিক্ষা অবিচল রাখিতে হইবে
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
“গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা অবিচল রাখিতে হইবে” গতকল্য (রবিবার) পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মাজারে সমবেত জনতা উপরােক্ত দৃঢ়সংকল্প ঘােষণা করেন।
গতকল্য সারাদেশে যথাযােগ্য মর্যাদার সহিত মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। সারাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মরহুম নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এইদিন ঢাকাতে ভাের হইতে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতা ও কর্মীগণ, ছাত্র ও জনসাধারণ মরহুম সােহরাওয়ার্দীর মাজার জিয়ারত করিতে আসেন এবং পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। সকাল হইতেই মাজার প্রাঙ্গণে কোরান তেলাওয়াত চলে।
সকাল সাড়ে দশটায় মাজার প্রাঙ্গণে মরহুম সােহরাওয়ার্দীর কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিকের উপর গৃহীত আলােকচিত্রের এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সােহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সােলেমান এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। বহুসংখ্যক লােক এই প্রদর্শনী দর্শনের জন্য ভীড় জমায়।
আলােচনাসভা
সন্ধ্যায় মাজার প্রাঙ্গণে এক মনােজ্ঞ আলােচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মরহুম সােহরাওয়ার্দীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করিয়া তাহার আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য সঙ্কল্প ঘােষণা করা হয়।
সভায় মরহুমের জীবনের বিভিন্ন দিক লইয়া আলােচনা করেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ কুদরত-ই-খুদা, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক জনাব তােফাজ্জল হােসেন, আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মালিক গােলাম জিলানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও জনাব আবদুস সালাম। সভায় সভানেত্রীত্ব করেন কবি সুফিয়া কামাল।
ডঃ কুদরত-ই-খুদা
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ডঃ কুদরত-ই-খুদা বলেন, আত্মচেতনার সার্থক। অভিব্যক্তি ঘটিয়াছিল মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর জীবনে। আত্মচেতনাই একটি জাতির জাগরণের মূল উৎস। তিনি বলেন, শৈশব হইতে সােহরাওয়ার্দীর ন্যায়ের প্রতি একান্ত বিশ্বাস ছিল। তাই তিনি তাঁহার। সমস্ত জীবন ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করিয়া গিয়াছেন।
তােফাজ্জল হােসেন
সভায় এক লিখিত প্রবন্ধ পাঠ প্রসঙ্গে মরহুম সােহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ সহচর দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক জনাব তােফাজ্জল হােসেন বলেন যে, মরহুম সােহরাওয়ার্দী ছিলেন সত্যিকারের জনগণের নেতা। জনসাধারণ ছিল তাঁহার সকল প্রেরণা, কর্মোদ্যোগ ও শক্তির উৎস। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সােহরাওয়ার্দীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করিয়া তিনি বলেন যে, মরহুম। সােহরাওয়ার্দী ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্ত্র সাধক। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম চালাইয়া গিয়াছেন। তিনি বলেন যে, মরহুম সােহরাওয়ার্দী সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতেই কর্মোদ্যোগ গ্রহণে অধিক আগ্রহী ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি একক ও অখণ্ড পাকিস্তানী জাতীয়তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে জনাব তােফাজ্জল হােসেন যুক্ত নির্বাচনের জন্য জনাব সােহরাওয়ার্দীর ভূমিকা আলােচনা করেন।
মালিক গােলাম জিলানী
পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা মালিক গােলাম জিলানী তাঁহার বক্তৃতায় জনসাধারণকে মরহুম সােহরাওয়ার্দীর আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করিতে আহ্বান জানান।
জনাব জিলানীও তাঁহার ওজস্বিনী বক্তৃতায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনাব সােহরাওয়ার্দীর অবদানের কথা উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে জনাব জিলানী মরহুমের গৃহীত পররাষ্ট্রনীতির কথা আলােচনা করেন। তিনি বলেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দী যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন তবে পাকিস্তানকে সাহায্যদানের জন্য যে দেশই অগ্রসর হইত উহার সাহায্য তিনি গ্রহণ করিতেন।
শেখ মুজিবুর রহমান
সভায় এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, মরহুম সােহরাওয়ার্দীর প্রদর্শিত পথে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখিতে হইবে। তিনি বলেন যে, মরহুম সােহরাওয়ার্দী জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম চালাইয়া গিয়াছেন এবং বহু ক্লেশ ভােগ করিয়াছেন। বেগম সুফিয়া কামাল সভানেত্রীর ভাষণে। সভানেত্রীর ভাষণে বেগম সুফিয়া কামাল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর আদর্শ ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিফলিত করিবার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। বেগম সুফিয়া কামাল মরহুমের স্মৃতি রক্ষার জন্য গরীবমেধাবী ছাত্রদিগকে বৃত্তিদান অথবা কোন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করার জন্য স্মৃতি রক্ষা কমিটির প্রতি আবেদন জানান।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব