You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
২৭শে জুলাই ১৯৬৫

ধূম্রজাল সৃষ্টি করিয়া মূল সমস্যা হইতে জনগণের দৃষ্টি ফিরাইয়া রাখার প্রয়াস
সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের আলােকে দেশবাসীর উদ্দেশে শেখ মুজিবের হুঁশিয়ারি

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবর রহমান গতরাত্রে এক বিবৃতি প্রসংগে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে ধূম্রজালের মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিয়া গণজীবনের মূল সমস্যা হইতে দেশবাসীর দৃষ্টি সরাইয়া রাখিবার সূক্ষ্ম কারসাজি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়া বলেনঃ দেশবাসীকে আমি স্পষ্ট ভাষায় স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সার্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার, প্রত্যক্ষ ভােটে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন এবং অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক তথা জীবনের সর্বক্ষেত্র হইতে বৈষম্য দূরীকরণের সংগ্রাম আজ আরও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। বিশেষ করিয়া আজ যখন দেশের কিছুসংখ্যক আত্মপ্রবঞ্চক সাঙ্গোপাঙ্গের যােগসাজশে ক্ষমতাসীনরা স্বার্থের অন্বেষণে মাতিয়া দেশব্যাপী বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টিতে তৎপর রহিয়াছেন।
তিনি বলেন যে, দায়িত্ব আজ আমাদের সামনে, যথাযােগ্যভাবে উহা আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সারাদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষের প্রতি আমি আগাইয়া আসিবার এবং সাধারণ কর্মসূচীর ভিত্তিতে হাতে হাত ধরিয়া কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান জানাইতেছি।
দেশবাসী আপামর জনসাধারণের প্রতি আমার আবেদন, জীবনমরণ সমস্যা হইতে জনগণের দৃষ্টি ফিরাইয়া রাখার জন্য বর্তমান শাসকমণ্ডলী ও তাঁহাদের একই নৌকার সওয়ারগণ আজ যে সূক্ষ্ম কারসাজিতে মাতিয়াছে, উহাতে বিভ্রান্ত না হইয়া গণতান্ত্রিক শিবিরের এই সংগ্রামে সমর্থন দিন।
শেখ মুজিব বলেন যে, আজ যে শাসকমণ্ডলীর পররাষ্ট্রনীতির তিনি সুউচ্চ প্রশংসা করিতেছেন, পুঁজিবাদী দেশের নিকট হইতে ঋণের পর ঋণ গ্রহণ করিয়া প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহারাই সমগ্র দেশকে বন্ধক দিয়াছেন-আওয়ামী লীগ নহে। মওলানা সাহেবের সেদিনের নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির থিওরী শেষ পর্যন্ত আজ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। বস্তুতঃ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেকোন আত্মসমশীল দেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথাই এই। কোন সম্রমশীল জাতিই এমন কোন দেশের সহিত- সে সাম্রাজ্যবাদীই হউক, আর অন্য কোন আদর্শেরই হউক লেনদেনে সম্মত হইতে পারে না, যদি সে লেনদেনের শর্ত জাতির পক্ষে অসম্মানকর বা অমর্যাদার নামান্তর হয়। এ-ধরনের ঝুঁকি এড়াইতে হইলে যে, কোন জাতিকে উহার গঠনমূলক তৎপরতার ক্ষেত্রে নিজ সম্পদের উপরই নির্ভর করিতে হয়।
কনসর্টিয়ামের বৈঠক দুই মাসের জন্য স্থগিত হওয়ার ফলে মার্কিন ঋণ পাওয়া যাইবে কি যাইবে না সে সম্পর্কে কেহই নিশ্চিত নন। প্রকৃত অবস্থাটা কি, দেশবাসীদের সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হইয়াছে। জাতীয় পরিষদে ১২ই জুন তারিখে উদ্বোধনী বক্তৃতা প্রসঙ্গে কনসর্টিয়ামের ঋণপ্রাপ্তির প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যে কথা শুনাইয়াছিলেন, তাহাতে একশ্রেণীর শ্রোতা নিশ্চয়ই আশ্বস্তবােধ করিয়াছিলেন। কিন্তু সেই হইতে আজ পর্যন্ত আর কেহ বলেন নাই যে, যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের শর্তের ক্ষেত্রে নূতন আবার কি প্রশ্ন দেখা দিয়াছে। যদি জাতির পক্ষে অসম্মানকর বা সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত করিবার মত নূতন কোন শর্ত উহাতে জুড়া হইয়া থাকে, তবে মার্কিন ঋণ আগমন বন্ধ হওয়ায় তাে মঙ্গলই হইয়াছে। সে অবস্থাতে বরং মওলানা সাহেবেরই তাে সবচেয়ে বেশী খুশী হওয়ার কথা। এ প্রশ্নে কোন হৈ-চৈ না। করিয়া বরং তিনি ইচ্ছা করিলে দুষ্টবুদ্ধিবর্জিত কোন নয়া সূত্রে ঋণ সংগ্রহের জন্য যত্নবান হইতে পারতেন। কিন্তু দেখিয়া-শুনিয়া মনে হইতেছে, মার্কিন ঋণপ্রাপ্তি মানসে ক্ষমতাসীন মহল আজ যে হৈ-চৈ সৃষ্টি করিয়াছে, মওলানা সাহেব নিজেও উহাতে সক্রিয়ভাবে শরীক হইয়াছেন। কিসের জন্য এ হৈচৈ, ইহা কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না। পাকিস্তান সমাজতন্ত্রী দেশসমূহের বিশেষ করিয়া চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব অর্জন করিয়াছে বলিয়া ক্ষমতাসীনরা দাবী করিতেছে। মওলানা সাহেবও এই দাবীর সহিত একমত। কিন্তু, তৃতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকল্পে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশ ব্যতীত অন্য কোন বিকল্পসূত্রে অর্থাগমের বা ঋণপ্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা তাে আমার নজরে পড়ে না, ইহা হইতেই কি বর্তমান শাসক মহলের অর্থনীতির ধরন ও পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার সত্যিকার স্বরূপ প্রকাশ হইয়া পড়ে নাই? অথচ, এই শাসকমহলের প্রশংসাতেই তাে মওলানা সাহেব আজ উচ্চকণ্ঠ। দেশবাসীকে তিনি জানাইবেন কি যে, বর্তমান শাসকরাই সিয়াটো ও সেন্টোর সহিত তাহাদের সম্পর্ক বজায় রাখার প্রস্তাবনা করে নাই?
ক্যাপ্টেন গ্রে পাওয়ার্সের অধীনে সেদিন পেশােয়ারের নিকটবর্তী যে মার্কিন ঘাটিটি হইতে ইউ-২ গােয়েন্দা বিমান রাশিয়ায় পাঠান হয়, উহাও বজায় রাখার প্রস্তাবনা বর্তমান সরকার করেন নাই কি? মওলানা সাহেব দেশবাসীকে জানাইবেন কি যে, কাহাদের শাসনামলে এইসব প্রস্তাবনা করা হইয়াছে এবং তাঁহার পছন্দসই পররাষ্ট্রনীতির তাঁহারা স্থপতি তাঁহারা এজন্য বিন্দুমাত্র অনুশােচনা বা গােয়েন্দা বিমানের, মালিকদের সহিত সহযােগিতা বর্জন করিয়াছেন কি? চীনা প্রধানমন্ত্রী মিঃ চৌ এন লাই সিয়াটো ও সেন্টো চুক্তিকে পাকিস্তানের নিরাপত্তার খাতিরে সম্পাদিত “কেবলমাত্র দেশরক্ষা চুক্তি” বলিয়া অভিহিত করার পর মওলানা সাহেব আজ হয়ত সিয়াটোসেন্টোর পক্ষে নূতন যুক্তি খাড়া করিতেও সক্ষম হইবেন।
মওলানা সাহেব এক্ষণে দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার অপেক্ষা পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারেই বেশী উদগ্রীব। তাই, বর্তমান সরকার কর্তৃক তাঁর নিজ পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়িত হইতে দেখিয়া তিনি আজ খুশী। নির্মম শােষণ চালাইয়া পুঁজিবাদীরা নিরীহ জনসাধারণকে রক্তশূন্য করে বলিয়া মওলানা সাহেব বরাবরই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া যাওয়ার সংকল্প ঘােষণা করিয়া আসিয়াছেন। দেশবাসী বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অবহেলিত ও নির্যাতিত জনগণকে তিনি এখন এই আশার বাণী শােনাইতে পারেন কি যে, তাহাদের দুশ্চিন্তার আর কোন কারণ নাই, তাঁহার পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নকারীদের শাসনাধীনে আজ তাঁহারা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং সর্বরকমের পুঁজিবাদী শােষণ হইতে আজ তাঁহারা মুক্ত? দেশবাসীকে-বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানীদের তিনি একথা শােনাইতে পারেন কি যে, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক সাম্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবী আজ তাঁহাদের পূরণ হইয়া গিয়াছে, একচেটিয়া পুঁজিবাদী শােষণের অবসান হইয়াছে, জীবনের সর্বস্তর আজ দুর্নীতিমুক্ত, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান আজ বৃদ্ধি পাইয়াছে, জনগণের সর্বনিম্ন চাহিদাও মিটিয়া গিয়াছে। বন্যা, ঘূর্ণিবাত্যা, সামুদ্রিক বানের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত হইতে প্রদেশবাসীকে রক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থাও গৃহীত হইয়াছে?
জানি, একদিন ছিল যখন মওলানা সাহেবই গণজীবনের এইসব সমস্যার প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠে দাবী জানাইয়া আসিয়াছেন; কিন্তু আজ সে কণ্ঠ স্তিমিত।
একদিন ছিল, যখন এইসব দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য মওলানা সাহেব জীবন বিসর্জনের ওয়াদা ঘােষণা করিতেন। কিন্তু অধুনা সবকিছু দেখিয়া-শুনিয়া মনে হয় না যে, পূর্ব পাকিস্তানের এইসব দাবী-দাওয়া আদায়ের প্রশ্নে তিনি আজ আর তেমন আগ্রহী—যেমন আগ্রহী তিনি আজ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের অধীনে পাকিস্তান বিপুল উন্নতি হাসিল করিয়াছে এবং আইয়ুবের নীতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে আরও অগ্রগতি হইবে- চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাইর এই ছাড়পত্র যদি তাহারও ছাড়পত্র হয়, তবে আমার আর কিছু বলিবার নাই। এতদসত্ত্বেও মওলানা সাহেবকে আমি জিজ্ঞাসা করিতে চাহি যে, অতীতে জনগণের সমর্থনবর্জিত কোন নেতার সম্পর্কে যখনই কোন বিদেশী অনুরূপ কোন মন্তব্য করিয়াছেন, তখন কি তিনি তাহার তীব্র প্রতিবাদ করেন নাই?
চীনা প্রধানমন্ত্রীর নিকট হইতে লব্ধ প্রেরণাই বর্তমান সরকারের প্রতি মওলানা সাহেবের সমর্থনের একমাত্র কারণ নয়, প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সহিত তাঁহার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও ইহার অন্যতম কারণ। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রাজবন্দীদের মুক্তির প্রশ্নে আলােচনার নামে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সহিত তাহার বৈঠকের মত কতিপয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণা করা আদৌ দূষণীয় নহে। এই সাক্ষাৎকারের ফলস্বরূপ গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া বিনাবিচারে কারাগারে আটক রাজবন্দীদের ভাগ্যে যাহা ছিল, তাহাই থাকিল, আর মওলানা সাহেব চীন সফরের জন্য গঠিত এক প্রতিনিধিদলের নেতৃপদে জাকিয়া বসিলেন। তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাঁহাকে এই পদে বসাইয়া। দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তিনি এক-আধবার মন্তব্য করিলেও উক্ত প্রতিনিধিদলের মূল্যবান’ নেতৃত্ব বর্জন বা চীন গমন বন্ধ রাখার মত স্পৃহা তাঁহার হয় নাই। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মােহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নাকে প্রার্থী মনােনীত করিতে মওলানা সাহেব খুবই উৎসাহ দেখান। কিন্তু, মিস্ জিন্না যখন নির্বাচনী অভিযানে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন, তাঁহারই কোন কোন সহচর আবার তখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের গলায় মালা পরাইলেন। অতীতে ছােটখাট রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিনে মওলানা সাহেবকে বিপন্ন মানুষের সাহায্যার্থ, কোটি কোটি টাকা মঞ্জুরের দাবী জানাইতে দেখা গিয়াছে। কিন্তু, এবার তাঁহার স্বর অনুচ্চ- এবং এতই অনুচ্চ যে, সাধারণ্যে শ্রুতিগােচর হওয়াও দুঃসাধ্য। শ্রমিক, ছাত্র, কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের উপর যে নির্যাতন চলিতেছে, সেদিকে এখন আর তাহার নজর দেওয়ার অবকাশ হয় না।
মওলানা সাহেব এখন খুবই বয়ােবৃদ্ধ। এই বয়সে সংগ্রামী ভূমিকায় নামিবার মত শক্তি ও সাহস তাঁহার কমিয়া যাইতেছে, এসত্য স্বীকার করিতে কারও সঙ্কোচবােধের কারণ নাই।
স্বভাবতঃই মওলানা সাহেবের বর্তমান পরিবর্তনের কারণ বােধগম্য। কিন্তু তাই বলিয়া দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তালগােল পাকাইয়া গণমনকে বিভ্রান্ত করার কোন অধিকার তাঁহার নাই; বর্তমান শাসকচক্রকে আড়াল করিয়া রাখার ছদ্মাবরণ সৃষ্টির নিমিত্ত আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে নাক গলানাের কোন অধিকারতাে তাঁহার নাই-ই নাই। জনগণ জানে, এবং মওলানা সাহেব নিজেও জানেন, আওয়ামী লীগের ভূমিকা কি।
অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সামান্য কয়েকদিনের সীমাবদ্ধ। জীবনে তাহারা দেশে পূর্ণ নাগরিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। পাকিস্তানের কোন কারাগারে তখন একজন রাজবন্দীও আর আটক ছিল না। জনাব সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি তখন এক নয়া মােড় পরিগ্রহ করে। চীনের এই প্রধানমন্ত্রী মিঃ চৌ এন-লাইই জনাব সােহরাওয়ার্দীর আমন্ত্রণে সর্বপ্রথম পাকিস্তান সফরে আসেন। মওলানা সাহেব হয়তাে সে স্মরণীয় দিনটির কথা বিস্মৃত হন নাই যেদিন ঢাকা ষ্টেডিয়ামে মিঃ চৌ-এন-লাইকে ঐতিহাসিক নাগরিক সম্বর্ধনা জানান হইয়াছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে মওলানা সাহেব নিজেই সেদিন এই সম্বর্ধনা সভার প্রধান অতিথি-সেবকের (হােষ্ট) ভূমিকা পালন করেন। কোন দেশের প্রটোকলের ক্ষেত্রে ইহা এক নয়া নজীর।
এইসব কারণে আমি আমার দেশবাসীকে স্পষ্ট ভাষায় স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সার্বজনীন বয়স্ক ভােটাধিকার, প্রত্যক্ষভাটে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন এবং অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক তথা জীবনের সর্বক্ষেত্র হইতে বৈষম্য দূরীকরণের সংগ্রাম আজ আরও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন, বিশেষ করিয়া আজ যখন দেশের কিছুসংখ্যক আত্মপ্রবঞ্চক সাঙ্গোপাঙ্গের যােগসাজশে ক্ষমতাসীনরা স্বার্থের অন্বেষণে মাতিয়া দেশব্যাপী বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টিতে তৎপর রহিয়াছেন। আওয়ামী লীগের সংগ্রামের ইতিহাস রাষ্ট্রজীবনে জনগণের সার্বভৌমত্ব, নির্ভেজাল গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং ক্রমিক বিবর্তনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক রূপ দিয়া দেশের আপামর জনসাধারণের ভাগ্যোন্নয়নেরই সংগ্রামের ইতিহাস। এইসব মৌলিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাই আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ নীতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সক্রিয় শরীকানার উপর ভিত্তি করিয়াই গড়িয়া তুলিতে হইবে। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে উহার নীতি এমনই স্বাধীন হইতে হইবে যাহাতে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সহিত সঙ্গতিসম্পন্ন জাতীয় স্বার্থে ও বিশ্বশান্তির জন্য উহা যথাযােগ্যভাবে স্বকীয় ভূমিকা অভিনয়ে সক্ষম হইতে পারে। এই অভীপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নিরবচ্ছিন্নভাবে তাহাদের সংগ্রাম চালাইয়া যাইবে।
যে দায়িত্ব আজ আমাদের সামনে, যথাযােগ্যভাবে উহা আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সারাদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষের প্রতি আমি আগাইয়া আসিবার এবং সাধারণ কর্মসূচীর ভিত্তিতে হাতে হাত ধরিয়া কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান জানাইতেছি।
দেশবাসী আপামর জনসাধারণের প্রতি আমার আবেদন, জীবনমরণ সমস্যা হইতে জনগণের দৃষ্টি ফিরাইয়া রাখার জন্য বর্তমান শাসকমণ্ডলী ও তাঁহাদের একই নৌকার সওয়ারগণ আজ যে সূক্ষ্ম কারসাজিতে মাতিয়াছে, উহাতে বিভ্রান্ত না হইয়া গণতান্ত্রিক শিবিরের এই সংগ্রামে সমর্থন দিন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!