You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক পাকিস্তান
২৮শে জুলাই ১৯৬৫

শেখ মুজিবের বিবৃতি
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক বিশৃংলা সৃষ্টির অধিকার নাই

(প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান গত সােমবার যে বিবৃতি প্রদান করেন তাহার প্রথম অংশ গতকল্য মঙ্গলবার দৈনিক পাকিস্তানএ প্রকাশিত হইয়াছে। অবশিষ্ট অংশ অদ্য প্রকাশিত হইল)।
শেখ সাহেব দাবী করেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নহে বরং বর্তমান সরকারের আমলেই পুঁজিবাদী দেশগুলির সহিত ঋণের বন্ধনে দেশকে একরূপ বন্ধক দিয়াছে। অথচ মওলানা ভাসানী এই সরকারের পররাষ্ট্রনীতিকে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা ও আওয়ামী লীগ সরকারের নিন্দা করিতেছেন। মওলানা সাহেবের পূর্বতন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির থিওরী। অবশেষে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে।
শেখ সাহেব মনে করেন যে, কনসর্টিয়ামের বৈঠক দুই মাসের জন্য স্থগিত হইয়াছে বলিয়াই যে, আমেরিকার ঋণ আর আসিবে না তাহা কেহই নিশ্চিতভাবে বলিতে পারে না। প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে দেশবাসীকে অনবহিত রাখা হইয়াছে; বরং বলা চলে যে, ভুল তথ্য দেওয়া হইয়াছে। গত ১২ই জুন জাতীয় পরিষদে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের উদ্বোধনী ভাষণে কনসর্টিয়ামের ঋণলাভের সংবাদে একশ্রেণীর শ্রোতা উৎসাহিত হইয়াছিল, অথচ পরে কি সব ঘটনার সৃষ্টি হইয়া যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের ব্যাপারে শর্তের ব্যাপারে ঘটিয়াছে। জাতিকে তাহা জানান হয় নাই। যদি নয়া শর্ত অসম্মানজনক হয়, তবে ঋণপ্রাপ্তি বন্ধ হওয়া ভালই হইয়াছে এবং মওলানা সাহেবের তাহাতে খুশী হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে তিনি যদি পছন্দ করেন, তবে এহেন অধিক হৈ চৈ না করিয়া দোষহীন সূত্রের সন্ধান করিয়া তথা হইতে ঋণের যােগাড় করিলেই পারেন; কিন্তু দেখা যাইতেছে যে, কনসর্টিয়ামের বৈঠক স্থগিত হওয়ার বিষয়টি লইয়া ক্ষমতাসীন চক্র যে সােরগােল করিতেছেন তাহাতে মওলানা সাহেব নিজকেও একজন সক্রিয় অংশীদার করিয়াছেন। ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ দাবী করেন এবং মওলানা সাহেবেরও তাহাই অভিমত যে, পাকিস্তান সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সহিত বিশেষ করিয়া চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব অর্জন করিয়াছে। কিন্তু তৃতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার জন্য সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী দেশসমূহ ছাড়া অর্থলাভের বিকল্প কোন সূত্র দেখিতেছি না। ইহা দ্বারাই কি বর্তমান শাসকদের অর্থনীতির প্রকৃতি ও পররাষ্ট্রনীতি পূর্ণভাবে প্রকাশ পাইতেছে না ? মওলানা সাহেব বলিবেন কি বর্তমান সরকার সীটো, সেন্টো ও পেশােয়ারের সন্নিকটে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাটি বহাল রাখিতে চাহে কিনা?
তিনি অভিযােগ করেন যে, মওলানা সাহেব সর্বদাই দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ের তুলনায় সর্বক্ষণই পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারেই অত্যাধিকভাবে জড়িত থাকেন। মওলানা সাহেব তাহার পররাষ্ট্রনীতিই বর্তমান সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত হইতে দেখিয়া সন্তোষ প্রকাশ করিতেছেন। তিনি সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকেন। কারণ সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতিরা নির্মমভাবে জনসাধারণকে শােষণ করে। মওলানা সাহেব বলিবেন কি যে, বর্তমান শাসনামলে জনসাধারণ বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানীরা পুঁজিপতিদের শােষণ হইতে নিরাপদ কিনা? আরও বলিবেন কি যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন লাভ করিয়াছে কিনা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান নাগরিক স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের শােষণ ও সর্বস্তরে দুর্নীতির অবসান ঘটিয়েছে কি ? একসময় ছিল যখন মওলানা সাহেব এইসব দাবী আদায়ের জন্য জীবনপণ করিতেন এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম”ও বলিতে চাহিতেন।
শেখ সাহেব মনে করেন যে, সামরিক শাসনামলে ধানমণ্ডীতে একখানি গৃহে আরামে কারারুদ্ধ থাকাকালে তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে সুদৃষ্টিতে দেখিতে শুরু করিয়াছেন।
তাছাড়া বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে শেখ সাহেব বলেন যে, চৌ এন লাই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিকে সার্টিফিকেট দেওয়ার ফলে মওলানা সাহেবও এই পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে একই নীতি পােষণ করেন।
এই সাথে শেখ সাহেব তাঁহার বিবৃতিতে দাবী করেন যে, মরহুম জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেই আমন্ত্রিত হইয়া চৌ এন লাই পাকিস্তান সফরে আগমন করিয়াছিলেন এবং ঢাকার ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা সভায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসাবে মওলানা ভাসানীকে দিয়া তাঁহার সম্বর্ধনা করা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী হিসাবে মনােনয়ন দান করিয়া মওলানা ভাসানী প্রথম কৃতিত্বের গৌরব লাভ করেন বটে; কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জরুরী সংকটকালে তিনি সেই চিরাচরিত ভগ্নস্বাস্থ্যের অজুহাতে দূরে সরিয়া যান।
ইহা ছাড়া ছােটখাটো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যিনি জীবন বিসর্জন দিতে চাহিয়াছেন এবং কোটি কোটি টাকার রিলিফ দাবী করিয়াছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁহার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর সুস্পষ্টভাবে শ্রুতিগােচর নহে। শ্রমিক, ছাত্র, কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মচারীদের উপর যে নির্যাতন হইতেছে তপ্রতি তাহার মনােযােগ আকর্ষণ করা যায় না।
শেখ সাহেব বলেন, মওলানা ভাসানী অতিবৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। কাজেই শক্তিসামর্থ্য হ্রাসের সত্যতা স্বীকার করিলে কেহই তাহার প্রতি বিদ্বেষ পােষণ করিবে না। কিন্তু রাজনীতি ক্ষেত্রে বিশৃংখলা সৃষ্টি ও জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার তাঁহার কোনাে অধিকার নাই।
পরিশেষে গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার প্রভৃতি দাবী আদায়ের সংগ্রামে আওয়ামী লীগের অটুট নীতি ব্যাখ্যা করিয়া শেখ মুজিবর রহমান জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাবী আদায়ের আন্দোলনে শরীক হওয়ার আবেদন জানান।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!