দৈনিক ইত্তেফাক
২৩শে মে ১৯৬৫
ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকার ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিকার সম্পর্কে শেখ মুজিব
সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেন ঃ গত ১১ই মে রাত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় অর্ধেক অংশের উপর দিয়া প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় বহিয়া গিয়াছে। এই ঝড়ের প্রচণ্ডতা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দৃষ্টে এ কথা বলিলে অস্বাভাবিক কিছু বলা হইবে না যে, গত কয়েক বৎসরের ঝড় অপেক্ষা ১১ই মে’র ঝড়ের ভয়াবহতা অনেক বেশী। সারারাত্র ব্যাপী প্রকৃতির এই তাণ্ডবলীলায় অসংখ্য লােকের প্রাণহানি ঘটিয়াছে, বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছে এবং এখনও পাওয়া যায় নাই। মাদারীপুরে আমি নিজেই এই প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পতিত হইয়াছিলাম। যতই দিন যাইতেছে দুর্গত অঞ্চল হইতে ততই ভয়াবহ খবর আসিয়া পৌছিতেছে।
শেখ মুজিব বলেন ঃ ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শতকরা ৮০ ভাগ টিনের গৃহ ও প্রায় এক শতভাগ কাঁচাগৃহ বিধ্বস্ত এবং ৭০ ভাগ গবাদিপশু নিহত হইয়াছে। ঝড়ের ফলে মৎস্যজীবীদের অসংখ্য নৌকা নিখোঁজ এবং যথেষ্ট পরিমাণে ফসলাদি নষ্ট হইয়া গিয়াছে। ধ্বংসলীলার ১১ দিন পরেও সমুদ্রের উপকূলবর্তী এলাকায় পৌছান সম্ভব না হওয়ায় তথাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা এখনও সম্ভবপর হয় নাই। দুর্গত এলাকায় প্রশাসনিক যন্ত্রগুলির কাজকর্মে অনেকটা ধীরগতিতে চলিতেছে এবং জরুরী অবস্থার মােকাবিলা করিতে সরকার ব্যর্থ হইয়াছেন। সরকার মাত্র ২৫ লক্ষ টাকার ঋণ মঞ্জুর করিয়াছেন কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় ইহা সমুদ্রে একবিন্দু পানির সমান। সরেজমিনে তদন্ত না করিয়া শুধু ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে একটি ধারণা করিয়া হিসাব প্রস্তুত করার ফলে সরকার এই স্বল্পসংখ্যক সাহায্য মঞ্জুর করিতে পারিয়াছেন। এই জাতীয় জরুরী অবস্থায়। এখন পর্যন্ত আমাদের সেনাবাহিনীর সাহায্য কেন লওয়া হয় নাই তাহা ভাবিলে হতবাক হইতে হয়। পূর্বে জাতীয় দুর্যোগের সময় সেনাবাহিনী তাহাদের গৌরবময় ভূমিকা পালন করিয়াছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন ঃ প্রয়ােজনের সময় রিলিফ মঞ্জুর না করিলে পরে রিলিফ মঞ্জুরীর কথা ঘােষণা করিলে উহা কোন কাজে আসিবে না। সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে ‘জাতীয় জরুরী অবস্থার মােকাবিলা করার জন্য সমস্ত শক্তি নিয়ােগ করা। জরুরী অবস্থার মােকাবিলা করার জন্য দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের সহযােগিতা এবং বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের নিকট শেখ মুজিবের বিবৃতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ গতকল্যকার ইত্তেফাকে প্রকাশিত হইয়াছে।
সাহায্য প্রার্থনা করাও সরকারের কর্তব্য। তিনি বলেন , দুর্গত এলাকায় অনতিবিলম্বে সরকারী সাহায্য এবং দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী ঋণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য হইয়া পড়িয়াছে।
সম্মিলিত বিরােধী দলের অন্যতম নেতা শেখ মুজিব বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে অবিলম্বে পানীয় জল, শিশুদের খাদ্য, কাপড়, ঔষধ, নগদ টাকা ও গৃহনির্মাণের জিনিসপত্র পাঠানাের আশু প্রয়ােজন দেখা দিয়াছে। দু’দিন অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত ট্যাক্স, খাজনা এবং সার্টিফিকেটের টাকা আদায় বন্ধ করা উচিত। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কর্মচারীদের কমপক্ষে ৩ মাসের অগ্রিম বেতন দেওয়া প্রয়ােজন। তাণ্ডবলীলায় ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রয়ােজনীয় খরচপত্র নির্বাহ করার জন্য তাহাদের সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষমতাদান করিয়া অবিলম্বে অর্ডিন্যান্স জারি করা উচিত।
আওয়ামী লীগ নেতা বলেন ঃ সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনসাধারণকে ভবিষ্যতে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের হাত হইতে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত গৃহনির্মাণের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত জরুরী হইয়া পড়িয়াছে। উল্লিখিত এলাকাসমূহে সরকারের পাকাবাড়ী নির্মাণ করিয়া দেওয়া উচিত। যাহাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী এবং জনসাধারণ কিস্তিবন্দীতে টাকা পরিশােধ করিয়া সরকার কর্তৃক নির্মিত পাকাবাড়ীর মালিকানা নিজেদের করিয়া লইতে পারেন। পরিশেষে শেখ মুজিব ‘গ্রাম্য হাউজিং পরিকল্পনার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানান।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ দ্বিতীয় পর্ব