You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
৩০শে জানুয়ারী ১৯৬৫

একতরফা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ কর
উপযুপরি হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি
শেখ মুজিবের আহ্বান

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (শুক্রবার) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান সুপরিকল্পিতভাবে স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের গণ-সংগ্রামকে বানচাল করার ষড়যন্ত্রের তীব্র নিন্দা করেন। বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর হইতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক যেসব নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইতেছে সেই সম্পর্কে তিনি সরকার ও দেশবাসীর কাছে এক মহা জিজ্ঞাসা তুলিয়া ধরিয়াছেন। তিনি বলেন যে, জনাব বেলুচের উপর হামলা গােটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর হামলা এবং তাহার উপর গুলীবর্ষণ দেশবাসীর কলিজার উপর গুলীবর্ষণেরই শামিল।
আততায়ীর গুলীতে নিহত সাংবাদিকের মৃত্যুতে শেখ মুজিব গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন। জনাব বাকী বেলুচের সঙ্কটাপন্ন অবস্থার সংবাদে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন।
শেখ মুজিব বলেন যে, জনাব বাকী বেলুচের জীবনের উপর এই ধরনের ভয়াবহ হামলা স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশমাত্র এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের গণ-সংগ্রামকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে ইহা একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বৈ কিছুই নয়! নৃশংস আক্রমণের কবল হইতে জনাব বাকী বেলুচ উদ্ধার পাইবেন কি-না তাহা পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালাই জানেন।
জনাব বেলুচের সংগ্রামী জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, জনাব বাকী বেলুচ পরিষদের ভিতরে ও বাহিরে গণতন্ত্রের দাবীতে দুর্বার সংগ্রাম করিয়াছেন। ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি ও জবরদস্তির ইতিহাস তিনি যে নির্ভীকতার সহিত উদঘাটন করিয়াছেন, তাহাতে তিনি দেশবাসীর কাছে বিশিষ্ট সম্মানের অধিকারী হইয়াছেন। পরিষদের ভিতরে ও বাহিরে তাহার বক্তৃতা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে বটে; কিন্তু এইসব অনলবর্ষী বক্তৃতাই ক্ষমতাসীন দলের তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করিয়াছে। বেলুচিস্তানের নির্যাতিত জনসাধারণের আশা-আকাংক্ষা জনাব বেলুচ সার্থকভাবে প্রতিফলিত করিয়াছেন। জনাব বেলুচের জীবনের উপর যে মারাত্মক হামলা করা হইয়াছে, সেই হামলা গােটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর হামলা এবং জনাব বেলুচের দেহে যে গুলীবর্ষিত হইয়াছে, সে গুলী আসলে দেশবাসীর কলিজায়ই বর্ষণ করা হইয়াছে। শেখ মুজিব দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর হইতে অদ্যাবধি একদল দুষ্কৃতিকারীর উন্মত্ততার কবলে অসহায় মানুষ আত্মাহুতি দিতেছে, আর দুর্ভাগা দেশবাসী এইসব হত্যাকাণ্ড দুঃখের সহিত লক্ষ্য করিতেছে। পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে ডেপুটি স্পীকার হত্যার দোহাই দিয়া যাহারা একদিন বেআইনীভাবে ক্ষমতা দখল করিয়াছিলেন, দেশবাসী আজ তাঁহাদের এই প্রশ্নই করিতে চায়, শুধুমাত্র উন্মত্ততার শিকার হিসাবে কেন এবং কিভাবে এতসব জীবন নষ্ট হইতে দেওয়া হইল? এতে ইহাই কি প্রমাণ হয় না যে, দেশে আইনের শাসনের নামে পূর্ণাঙ্গ আইনহীন পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে? এই কথাই কি মনে হয় না যে, দেশে যদি আইন কিছু থাকিয়াও থাকে, তবে তাহা জংলী আইন? যদি তাহা না হইবে তবে কেন করাচীতে মানুষের মূল্যবান জীবন নষ্ট হইয়াছে? যদি তাহা না হইবে তবে কেন করাচীর বুকে শত শত অসহায় মানুষকে গৃহহারা করা হইয়াছে? দেশে যদি আইনের শাসনই থাকিবে তবে মারী উপজাতির নেতা মীর দোদা খানসহ পশ্চিম পাকিস্তানের তিনজন বিশিষ্ট নাগরিক আততায়ীর হাতে খুন হইয়াছেন কেন? এই ঘটনার পরদিনই লায়ালপুরে চারজন নির্দোষ নাগরিককে হত্যা করা হইয়াছে কেন? পূর্ব পাকিস্তানের সিলেটে ক্ষমতাসীন দলের জনৈক নেতা একজন বিরােধী দলীয় নেতাকে কেন এভাবে হত্যা করিলেন? ঢাকার বিশিষ্ট একশ্রেণীর লােকের হাতে দুই দুইজন নিরীহ নাগরিক কেন আত্মাহুতি দিলেন?
শেখ মুজিব বলেন যে, এইসব ঘটনা হইতে ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর হইতে সংঘটিত উপরােল্লিখিত সব হত্যাকাণ্ডের শিকার বনিয়াছেন বিরােধী দলের নেতা বা কর্মী। আরও দেখা যায় যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সরকারে সকল মহলের দাবীকে উপেক্ষা করিয়া বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন নিয়ােগে বিরত রহিয়াছেন। এইসব কারণে সহজেই মনে করা যায় যে, এইসব নৃশংস ঘটনার পশ্চাতে গােপন কোন হাত আছে। এবং একের পর এক যে ঘটনাপ্রবাহ চলিয়াছে, তাহাকে একতরফা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলিয়াই মনে করা যায়। অবশ্য একতরফা এইসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই ইহাদের শেষ নয়। আমার স্থির বিশ্বাস যে, যদি বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হইত তবে ‘গােপন হাত’ সব ধরা পড়িত এবং দেখা যাইত যে, বিশেষ একটা শিবিরেই এইসব গােপন হাতের আস্তানা।
শেখ মুজিব বলেন যে, জমির আহমদের হত্যা এবং জনাব বাকী বেলুচের উপর গুলীবর্ষণ সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলিয়াই মনে হয়। সম্ভবতঃ জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য এবং গণতন্ত্রের বীরসেনানী জনাব গােলাম জিলানী মালিককেও এই গুলীবর্ষণের মধ্যদিয়াই পৃথিবী হইতে অপসারিত করার ষড়যন্ত্র ছিল। কিন্তু নেহায়েত স্বর্গীয় সাহায্যেই যেন জনাব জিলানী মালিক এই ষড়যন্ত্রের কবল হইতে রেহাই পাইয়া গেলেন।
রাজনীতিতে যাহাদের মােকাবেলা করিতে ক্ষমতাসীন দলের সাহস নাই, তাঁহাদের জীবন লইয়া খেলাকে আর আস্কারা না দেওয়ার জন্য শেখ মুজিব সরকারকে সতর্ক করিয়া দিয়াছেন। তিনি দাবী করেন যে, অসৎ উদ্দেশ্যোদ্ভূত ও পূর্বপরিকল্পিত এই ধরনের ভয়াবহ হামলা বন্ধ করিতেই হইবে। চিরদিনের জন্য এইসব হামলার অবসান ঘটাইতে হইবে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!