দৈনিক পয়গাম
২রা আগস্ট ১৯৬৫
মার্কিনীদের কেন নির্লজ্জ সমর্থন করিতেছেন?
শেখ মুজিবরের প্রতি ন্যাপের জিজ্ঞাসা
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
হঠাৎ কোন শক্তির নির্দেশে বা প্ররােচনায় অথবা ‘ভালবাসার প্রতিদান দিতে গিয়া আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান বিগত ২৬শে জুলাই এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রতি হিংস্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতির সমর্থন এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের জন্য বর্তমান সরকার এবং ইহা সমর্থনের ‘অপরাধে বয়ােবৃদ্ধ জননেতা মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে বিষােদগার করিয়াছেন তাহা বিভিন্ন মহলে এখনও বিস্ময় ও সন্দেহের সুরে আলােচিত হইতেছে।
“(শেখ মুজিব) এমন নির্লজ্জ সমর্থন কেন দান করিতেছেন।” বিভিন্ন মহলে এই প্রশ্ন উখিত হইয়াছে যে কোন শক্তির প্রেরণায় শেখ মুজিব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় অনুভূতি ও আবেগের প্রতি ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করিবার সাহস সঞ্চয় করিয়াছে? ইহাও আলােচিত হইতেছে যে, হঠাৎ শেখ সাহেব কেন মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ছড়াইয়া ১৯০ লাইনের বিবৃতি প্রকাশ করিলেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র “জনতা” সম্প্রতি এক দীর্ঘ রিপাের্টে শেখ মুজিবর সহ মার্কিন প্রেমিকদের স্বরূপ উদঘাটন করিয়াছেন। উক্ত পত্রিকার রিপাের্টের এক অংশে বলা হইয়াছে মার্কিনী ব্লাকমেলের বিরুদ্ধে জনসাধারণের মনে যত ঘৃণাই সঞ্চিত থাক, দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তাহারা যত অবিচল ও আপােষহীন মনােভাবই গ্রহণ করিয়া থাকুক কিন্তু দেশের এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং সংবাদপত্র এই জটিল মুহূর্তে প্রত্যক্ষ প্রচ্ছন্ন অথবা অজানিতভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকদের ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যেখানে হুমকির জবাবে স্পষ্ট কণ্ঠে বলেন যে, আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি, কাহারও প্রভুত্ব চাই না সেখানে বিরােধী দলের নেতারা মদমত্ত জনসন সরকারের নিকট সার্বভৌমত্ব বিকাইয়া দিয়া ভিক্ষাপাত্র প্রসারের পক্ষপাতী।” উক্ত পত্রিকা এদেশের তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেতাদিগকে “সাম্রাজ্যবাদের অর্থপুষ্ট” বলিয়া অভিযোেগ আনয়ন করেন। উক্ত পত্রিকায় এইসব তথাকথিত বিরােধী রাজনৈতিক নেতাদের শাসনামলে কি জাতীয় ন্যক্কারজনক ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে, তাহার বিসদ বিবরণ দান করা হয়। পত্রিকায় বলা হয়, “এই সমস্ত নেতাদের শাসন আমলে জনসাধারণ কতটুকু রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাইয়াছে, দুর্নীতি কতখানি বন্ধ হইয়াছিল, জনসাধারণ কতখানি অর্থনৈতিক সুবিধা পাইয়াছিল তাহা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। সম্প্রতি যাহারা বিরােধী দলে আসন গ্রহণ করিয়াছেন, একদিন তাহারা এদেশে বিস্তৃত এবং ব্যাপক অত্যাচারের ব্যবস্থা প্রণয়ন করিয়াছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদানের গর্ব করিয়া থাকেন কিন্তু তাহারা যে আবার বিরােধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা ও লাঞ্ছনা করিবার জন্য গুণ্ডা লেলাইয়া দিয়াছিলেন, সে কথা সম্ভবতঃ এত শীঘ্রই ভুলিয়া যাওয়া সম্ভব নয়। শেখ মুজিবর রহমান আবার স্বমূর্তি ধারণ করিতে চাহিতেছেন। মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে যে কদর্য ও হীন ভাষায় তিনি বিবৃতি দিয়াছেন, তাহা হইতে ইহা অনুমান করা খুব কঠিন নয় যে, তিনি ও তাহার অনুসারিগণ যদি এখনও ক্ষমতাসীন থাকিতেন তবে আট বছর আগে রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাপ কর্মীদের উপর সশস্ত্র গুণ্ডাদের “রুদ্ররােষ” ফাটিয়া পড়িয়াছিল, এবারও তাহার পুনরাবৃত্তি হইত। সম্ভবতঃ সাধ থাকিলেও সাধ্য না থাকার বেদনায় তিনি জর্জরিত হইতেছেন।” পাকিস্তানের সহিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব এবং পাকিস্তানের নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে ন্যাপের সমর্থনকারী মুখপত্র “জনতায়” বলা হইয়াছে, “(আমেরিকার সহিত পাকিস্তানের)” দ্বন্দ্ব শুরু হইয়াছে যখন পাকিস্তান, সােভিয়েট ইউনিয়ন ও চীনের সহিত বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন করিয়াছে, যখন পাকিস্তান ভিয়েত্রামে হানাদার সৈন্য পাঠায় নাই, যখন পাকিস্তান সিয়াটো ঘােষণাপত্রে পুরাপুরি সম্মতি দেয় নাই, যখন পাকিস্তান বাণিজ্যকে বহুমুখী করিয়াছে, যখন আফ্রোএশীয় দেশগুলির সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদীদের গাত্রদাহটা কোথায়, তাহা বিশ্লেষণ করিলে এক্ষেত্রে প্রগতিশীলদের করণীয় ভূমিকা সম্পর্কে কোন দ্বিধা থাকিবার কথা নয়।”
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব