You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.12.12 | দেশের সর্বনাশ প্রতিরােধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান- মনােহরদীর বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতা | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
১২ই ডিসেম্বর ১৯৬৪

দেশের সর্বনাশ প্রতিরােধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান
মনােহরদীর বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতা

(ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি)
মনােহরদী (ঢাকা), ১১ই ডিসেম্বর নির্বাচনে পরাজয়ের সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মুখে আজ সরকারী দল বেপরােয়া হইয়া উঠিয়াছে। দিকে দিকে আজ ছাত্র জনতার উপর অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন চলিতেছে। পুলিসের গুলীবর্ষণে অসহায় ছাত্ররা প্রাণ দিতেছে। আজও ছাত্ররা কারাপ্রাচীরের অন্তরালে আবদ্ধ আছে। আজও বিনা বিচারে আটক বন্দীরা স্বাধীনতার নির্মম প্রহসনে কাতর হইয়া মৃত্যুর প্রহর গণিতেছে। এদেশের মানুষ স্বাধীনতার সপ্তদশ বর্ষেও আজ গােলাম হইয়া বসিয়া আছে। যে ছাত্র গুলীতে শহীদ হইল, যে ছেলে কারা প্রাচীরের অন্তরালে আটক আছে, বিনা বিচারে আটক যে রাজবন্দী মৃত্যুর প্রহর গণিতেছে, তাহাদেরও মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র ও আত্মীয়-পরিজন আছে, একবার হতভাগ্য মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র ও আত্মীয় স্বজনদের দৃষ্টিতে দেখুন। ভাবিয়া দেখুন, কেন তারা প্রাণ দেয়, কেন তারা জেল খাটে?
অদ্য স্থানীয় হাইস্কুল ময়দানে আয়ােজিত বিরাট এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সম্মিলিত বিরােধী দলের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবর রহমান উপরােক্ত মর্মে জনসাধারণের সম্মুখে এক প্রশ্ন তুলিয়া ধরেন। শেখ মুজিব আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, আপনারা কি বুঝেন না যে, কেন কচি ছাত্ররা পুলিসের গুলীর সামনে বুক পাতিয়া দেয়, কেন তাহারা পুলিস আর কনভেনশন লীগের গুণ্ডাদের হামলার সামনে আগাইয়া যায়। আপনারা কি বুঝেন না, কেন ছাত্ররা আজ মায়ের বুক খালি করিয়া কারাগারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করিতেছে। আপনারা কি বুঝেন না, কেন বিনা বিচারে আটক রাজবন্দীরা কারাগারের দুঃসহ জীবনে মৃত্যুর প্রহর গণিতেছে। আজ আপনাদের বুঝিতে হইবে যে, এই ত্যাগী ছাত্র আর রাজনৈতিক কর্মীরা আপনাদের মুখে হাসি ফুটাইবার জন্য আপনাদের ভবিষ্যৎকে সুন্দর করিয়া গড়িয়া তােলার জন্যই নিজেদের জীবনের সর্বনাশ ঘটাইয়াও আন্দোলন করে। শুধু বুঝিলেই চলিবে না, তাহাদের এই ত্যাগ তিতিক্ষাকে সার্থক করিয়া তােলার জন্য আপনাদের সকলেরই আজ প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করিতে হইবে। আজিকার এই কাজ বড় সহজ। মাদারে মিল্লাতকে জয়ী করিতে পারিলেই আপনাদের দায়িত্ব সুসম্পন্ন হইতে পারে। আজ সময় আসিয়াছে, আপনারা ভােট দিয়া যাঁহাদের নির্বাচিত করিয়াছেন, আপনাদের মনােনীত প্রার্থীকে ভােট দিতে তাহাদের বাধ্য করুন।
নির্বাচক মণ্ডলীর সদস্যদের উদ্দেশে শেখ মুজিব বলেন যে, আজ আপনারা এক একজন অন্যূন এক হাজার মানুষের মতামতের আমানত গ্রহণ করিয়াছেন এবং আমানতের খেয়ানত ঘটানাে ইসলাম বিরােধী। মনে রাখিবেন অন্ধকার কক্ষে ভােট দিলেও আল্লাহতায়ালা সবই জানিবেন। মনে রাখিবেন, আপনার একটি মাত্র ভােটের জন্য আজ আপনার ভবিষ্যৎ সন্তানসম্ভতি হয় আজাদ হইবে, নয় চিরদিনের জন্য গােলাম বনিয়া যাইবে। মনে রাখিবেন, এই দেশের মাটিতে আপনাকে বাস করিতে হইবে, মৃত্যুর পর এই দেশেই আপনার দেহ রক্ষিত হইবে, এই দেশ আপনারই দেশ। সাময়িক সুখ সুবিধার জন্য চিরদিনের মত দেশের সর্বনাশ করিবেন না।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন গ্রামবাসীদের মিছিল করিয়া ভােটারদের ভােটকেন্দ্রে লইয়া যাওয়ার জন্য শেখ মুজিব জনসাধারণকে পরামর্শ দেন।
অদ্য সকালে মােটরযােগে শেখ মুজিব এখানে আগমন করেন। পথিমধ্যে নরসিংহদি,শিবপুর, হাতিরদিয়া প্রভৃতি স্থানে স্থানীয় জনসাধারণ শেখ মুজিবকে বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে। বিভিন্ন স্থানে স্বাগত তােরণ নির্মাণ করা হয়। শিবপুর বাজারে জনাব আলাউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সংক্ষিপ্ত সভায় শেখ মুজিব বক্তৃতা করেন।
মনােহরদি জনসভায় স্থানীয় সম্মিলিত বিরােধীদলের সভাপতি জনাব নাজিমুদ্দিন সরকার সভাপতিত্ব করেন। স্থানীয় ছাত্র ও শ্রমিকদের পক্ষ হইতে শেখ মুজিবকে দুইটি মানপত্র দান করা হয়। জনাব সিরাজুল হক এবং জনাব ফজলুর রহমান সভায় বক্তৃতা করেন। মেসার্স আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া, আশরাফ উদ্দিন খােন্দকার, মইজউদ্দিন, বজলুর রহমান, আমিনুল হক, ফজলুর রহমান, আফাজ উদ্দিন, আলাউদ্দিন প্রমুখ নেতা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ হইতে সভায় যােগদান করার জন্য মনােহরদি আগমন করেন।
ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পথে নরসিংদিতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব আফছার উদ্দিন ভূঁইয়া নেতৃবৃন্দকে চা পানে আপ্যায়িত করেন।
নেতৃবৃন্দের লাকসাম যাত্রা
অদ্য শনিবার সকাল ৭টায় শেখ মুজিবর রহমান আওয়ামী লীগ দলীয় এম,এন,এ জনাব লুতফর রহমান খান ও এডভােকেট জনাব এম,এ, রব লাকসাম রওয়ানা হইবেন। বৈকালে তাঁহারা লাকসামে এক জনসভায় বক্তৃতা করিবেন। অদ্যই তাঁহারা ঢাকায় ফিরিয়া আসিবেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব