You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইত্তেফাক
৭ই ডিসেম্বর ১৯৬৪

তবে কি নির্বাচনী কমিশন সরকারের পরামর্শক্রমেই কাজ করিতেছেন?
-শেখ মুজিব

“নির্বাচনী কমিশন ১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভােট গ্রহণের তারিখ ঘােষণা করিয়াছেন। কমিশন কর্তৃক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মনােনয়নপত্র আহ্বানের ন্যায় এই ঘােষণাটিও একান্তই আকস্মিক। কিন্তু কমিশনের তারিখ ঘােষণার অনেক আগেই খান এ, সবুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ সম্পর্কে যেরূপ সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, তাহাতে এই ধারণাই বদ্ধমূল হয় যে, এই তারিখ ধার্যের ব্যাপারে সরকারের নিকট হইতে সরাসরি নির্দেশ গ্রহণ না করা হইলেও নির্বাচনী কমিশন এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই মতামত বিনিময় করিয়াছেন।”
সম্মিলিত বিরােধী দলের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা শেখ মুজিবর রহমান গতকল্য (রবিবার) সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা প্রশ্নে উপরােক্ত মন্তব্য করেন।
এই প্রসঙ্গে শেখ মুজিব আরও উল্লেখ করেন যে, নির্বাচনী কমিশন ও ইহার প্রাদেশিক এজেন্সিগুলির সাম্প্রতিক কার্যাবলীর যৌক্তিকতা সম্পর্কে জনগণের মনে প্রশ্ন জাগিয়াছে। জেলা জজ ও অধস্তন জজদের লইয়া নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত পূর্ববর্তী বিজ্ঞপ্তি বাতিল করিয়া এডিশনাল কমিশনারদের লইয়া নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল পুনগঠনের জন্য প্রদত্ত নির্দেশটি কমিশনের সমালােচনাযােগ্য কার্যাবলীর সর্বশেষ নিদর্শন। আমি কমিশনের নিকট এই সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করিয়া পূর্ববর্তী নির্দেশ পুনর্বহালের দাবী জানাইতেছি। এখন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জনগণের মন হইতে সকল প্রকার সন্দেহ দূর করিয়া নির্বাচনী কমিশনের জনগণের আস্থা অর্জন এবং সরকার পক্ষীয় লােকদের কোন প্রকার কাজ বা উক্তির ফলে যাহাতে কমিশনের অবাধ কার্যক্রমের পথে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, তাহার নিশ্চয়তা বিধান করা উচিত।
শেখ মুজিব বলেন, এই প্রসঙ্গে আমি দেশবাসীর উদ্দেশে কয়েকটি কথা আরজ করিতে চাই। তিনি বলেন, কার্যতঃ আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইবে। ভােটাভুটির যেসামান্য সুযােগ পাওয়া গিয়াছিল, উহার মাধ্যমেই জনমত গণতন্ত্রের পক্ষে বিপুল সাড়া দিয়াছে। নির্বাচকমণ্ডলীর সাম্প্রতিক নির্বাচনকালে গণতন্ত্রকামী সকল প্রার্থীই মাদারে মিল্লাতকে ভােট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক জনাব আইয়ুব খানের নামে কেহই ভােটদাতাদের কাছে। যান নাই। জনসাধারণের রায়কেই যদি বিজয়ের মানদণ্ড বলিয়া গণ্য করা হইত, তাহা হইলে ইহা অনায়াসে বলা যায় যে, মাদারে মিল্লাত গণতন্ত্র অর্জনের সংগ্রামে জয়লাভ করিয়াছেন। আত্ম-প্রতারিত ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের এই রূঢ় সত্য জানা আছে বলিয়াই আজ তাহারা শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে সকল প্রকার জালিয়াতি, ধোকাবাজি ও মিথ্যার আশ্রয় লইয়াছেন।
তিনি বলেন, নির্বাচকমণ্ডলীর নব নির্বাচিত সদস্যদের বিভ্রান্ত করার জন্য বর্তমান সরকার ও সরকারী সাঙ্গ-পাঙ্গরা বিরােধী দলের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচার অভিযান চালাইয়াছে। জাতীয় পরিষদে মনােনয়ন প্রথা বিলােপ করিয়া সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও খান এ, সবুর খান ইউনিয়ন কাউন্সিল ও কমিটিতে সদস্য মনােনয়নের প্রলােভন দেখাইতেছেন। নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যদের নিরুৎসাহিত করার জন্য জনাব আইয়ুব খান ও তাহার তােষামােদকারীরা প্রচার করিতেছেন যে, বিরােধী দল জয়লাভ করিলে মৌলিক গণতন্ত্রী প্রথা ও ওয়ার্কস কর্মসূচী বাতিল করিবে, নব নির্বাচিত সদস্যদের সদস্যপদ খারিজ করিয়া দিয়া তিন মাসের মধ্যে নূতন নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবে। অথচ মাদারে মিল্লাত বার বার এ সমস্ত অলীক প্রচারণার সত্যতা অস্বীকার করিয়া তাহার কর্মসূচী ও নীতি ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এতদসত্বেও সরকার পক্ষের গােয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচারণা অব্যাহত রহিয়াছে। তাই সরকার পক্ষের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রচারণার জবাবে আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করিতেছি যে,
(১) বর্তমান আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন কাউন্সিল বা কমিটিতে কোন প্রকার মনােনয়ন চলিতে পারে না।
(২) মাদারে মিল্লাত ও সম্মিলিত বিরােধী দল মৌলিক গণতন্ত্র প্রথা বাতিল করিবেন না। কারণ ইহা কোন নয়া পদ্ধতি নয়। ইউনিয়ন বাের্ড নামে ইহা কয়েক দশক পূর্ব হইতেই বহাল রহিয়াছে। কেহই এই প্রথা বাতিলের কথাও কখনও চিন্তাই করে নাই।
(৩) নব নির্বাচিত সদস্যরা প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের পর ইউনিয়ন কাউন্সিল ও কমিটি সদস্য হিসাবে পূর্ণ পাঁচ বৎসর বহাল থাকিবেন।
(৪) নির্বাচকমণ্ডলীর বর্তমান সদস্যদের স্থলে মৌলিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নূতন করিয়া কোন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হইবে না। নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যদেরকেই মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্যে পরিণত করা হইবে। কারণ, তাহারা বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হইয়াছেন। মাদারে মিল্লাত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করিলে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসহ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে বয়স্ক ভােটাধিকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হইবে।
(৫) ওয়াকর্স কর্মসূচী বাতিল করা হইবে না। ইউনিয়ন কাউন্সিল ও কমিটিগুলিকে পরিকল্পিতভাবে ওয়ার্কস কর্মসূচী কার্যকরী করার ভার দেওয়া হইবে। মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্যদের উপর হইতে অহেতুক ও অবমাননাকর সরকারী নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হইবে। মৌলিক গণতন্ত্রী প্রতিষ্ঠান সকল প্রকার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হইয়া স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে অবাধ পরিবেশে কাজ করিবে। তাহারা পূর্ণ আত্মমর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হইবে।
(৬) শেখ মুজিব বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে যে-সময় দেওয়া হইয়াছে, তাহা অতি সংক্ষিপ্ত। কিন্তু বিরােধী দলের সম্মুখে বিরাট কাজ পড়িয়া রহিয়াছে। কিন্তু সরকার পক্ষ কনভেনশন পন্থী লীগের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জনাব আইয়ুব খানের সুবিধার্থ বেআইনীভাবে সকল প্রকার সরকারী সম্পদ ও প্রচার-যন্ত্র ব্যবহার করিতেছেন।
বৃহৎ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে তাঁহারা বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করিতেছেন। কারণ, বর্তমান সরকার এই ধনিক-বণিক গােষ্ঠীরই স্বার্থ সংরক্ষণে দৃঢ়সঙ্কল্প। তাঁহারা সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সকল প্রকার যানবাহন ব্যবহার করিতেছেন। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বেসামরিকদের যানবাহনও বাদ যাইতেছে না।
সরকারী পক্ষের যেখানে এত সুযােগ-সুবিধা, তখন আমাদের বাস্তব ক্ষেত্রে কিছুই নাই। তবে আমাদের যাহা আছে, উহা আর কাহারও নাই। আমাদের এই বস্তুটি হইতেছে, হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনগণের অটল সঙ্কল্প। ইহাই আমাদের একমাত্র সম্পদ। তাই আমি আমাদের মহান জাতির সকল শ্রেণীর, বিশেষভাবে যুবক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জনসাধারণকে মাদারে মিল্লাতের নির্বাচনী অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করিয়া যাওয়ার আহ্বান জানাইতেছি। নির্বাচক মণ্ডলীর নব নির্বাচিত সদস্যগণ ইতিমধ্যেই মাদারে মিল্লাত ও গণতন্ত্রের পক্ষে ভােট দেওয়ার ওয়াদা করিয়াছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীতে এমন শক্তি নাই- যাহা ভয়-ভীতি ও প্রলােভন দিয়া মৌলিক গণতন্ত্রীদের কর্তব্য ও সঙ্কল্পচ্যুত করিতে পারে। আমাদের নির্বাচকরা জানেন যে, তাহাদের সন্তানরা, শত শত ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী এখনও কারান্তরালে পচিয়া মরিতেছে। শ্রমিক, শিক্ষক ও অন্যান্য স্বল্প বেতনভােগী কর্মচারীদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া মানিয়া লওয়াই হয় নাই, বরং তাহাদের উপর চালানাে হইয়াছে অকথ্য নির্যাতন ও গােলাগুলী। বর্তমান সরকার বৃহৎ শিল্পপতিদের দশ বৎসরের জন্য বিপুল অঙ্কের কর হইতে অব্যাহতি দিয়া দরিদ্র জনসাধারণের উপর বহু করের বােঝা চাপাইয়াছেন। বর্তমান সরকার দরিদ্রদের প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম এত বাড়াইয়া দিয়াছেন যে, উহা তাহাদের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। এই সমস্ত অনাচারের প্রতিকারের জন্য জনসাধারণের হাতে যে ভােটের অস্ত্র ছিল, উহা তাহারা এই আশায় নির্বাচক মণ্ডলীর হাতে তুলিয়া দিয়াছে যে, জনগণের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী বর্তমান সরকারকে খতম করার জন্য এই অস্ত্রের সুষ্ঠু প্রয়ােগ হইবে। আমার বিশ্বাস, নির্বাচক মণ্ডলী জনগণের আস্থার মর্যাদা রক্ষা করিবে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মনােভাব আমার জানা আছে। আল্লার কৃপায় আমাদের জয় অবধারিত, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জয় সুনিশ্চিত। সত্যের দৃপ্ত বিজয়াভিযানে মিথ্যার কুয়াশা কাটিয়া গিয়া নব প্রভাতের সূচনা হইবে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!