ইত্তেফাক
১৫ই নভেম্বর ১৯৬৪
দুনিয়ার সর্বত্র একনায়কত্ব
ব্যর্থ হইয়াছেঃ জেঃ আজম
‘এইবার হয় মানুষের জয় না হয় মৃত্যু’
– শেখ মুজিব
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (শনিবার) কেরানীগঞ্জ থানার কালিগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত বিরােধী দলের এক বিরাট জনসভায় লেঃ জেনারেল আজম খান এবং শেখ মুজিবর রহমান দেশের সত্যকারের আজাদী ও জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব ফিরাইয়া আনার জন্য আপােষহীন সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
নেতৃদ্বয় ঘােষণা করেন যে, জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত একমাত্র গণতান্ত্রিক সরকারই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনিতে পারে, দেশবাসীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করিতে পারে এবং ভাবীকালের নাগরিকদের জন্য একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সম্ভাবনা রচনা করিতে পারে। সভায় উপস্থিত কয়েক সহস্র মানুষ হস্ত উত্তোলন করিয়া মাদারে মিল্লাত ও সম্মিলিত বিরােধী দলের প্রার্থীকে জয়যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন।
জেনারেল আজম ঘােষণা করেন যে, সভ্যজগতের কেহই একনায়কতন্ত্র বরদাশত করিতে পারে না। তাই পাকিস্তানবাসীমাত্র একনায়কতন্ত্র চায় না। দুনিয়ার সর্বত্র একনায়কতন্ত্র ব্যর্থ হইয়াছে। পাকিস্তানে একনায়কতন্ত্র সম্পূর্ণ অচল।
জেনারেল আজম দেশবাসীকে বলেন যে, মাদারে মিল্লাতের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোন প্রয়ােজনই ছিল না। দেশবাসীর হৃত অধিকার পুনরুদ্ধার করার জন্যই আজ মাদারে মিল্লাত নির্বাচনে অবতীর্ণ হইয়াছেন। আপনারা জানেন, মাদারে মিল্লাত পাকিস্তানের মানুষের কাছে যে শ্রদ্ধা-সম্মান পাইয়া থাকেন, কোন দেশের প্রেসিডেন্টও স্বদেশের মানুষের কাছে ততােখানি সম্মান পান না।
চলতি নির্বাচনে নিরপেক্ষ প্রার্থী সম্পর্কে জেনারেল আজম বলেন যে, নির্বাচন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম- এখানে নিরপেক্ষতাবাদ বলিয়া কোন জিনিস নাই। আপনারা জানিয়া রাখুন যে, নিরপেক্ষতাবাদীরা সুবিধাবাদী এবং সুযােগ পাইলেই ইহারা ঈমান বিক্রয় করিবে। তিনি সম্মিলিত বিরােধী দলের প্রার্থীকে ভােট দেওয়ার জন্য ভােটারদের অনুরােধ করেন।
শেখ মুজিবর রহমান সরকারকে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়া বলেন যে, বর্তমান শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী কোন ব্যবস্থা যদি কোন মহল গ্রহণ করে, তবে তাহার জন্য জনাব আইয়ুবকেই দায়ী করা হইবে। বিপ্লবের নামে আবার যদি দেশবাসীর সংগ্রামকে বানচাল করিয়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানবাসী সর্বশক্তি দিয়া তাহা রুখিয়া দাঁড়াইবে। এইবার হয় মানুষের জয়, নয় মৃত্যু।
সরকারকে স্মরণ করাইয়া দিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, জুলুম প্রতিরােধ দিবসে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা একদিনের জন্য বন্ধ ছিল। স্বৈরাচারী সরকারের স্বৈরাচার বন্ধ করার জন্য প্রয়ােজনবােধে মাসের পর মাস দেশে হরতাল করা হইবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালানাে হইবে।
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী সভায় সভাপতিত্ব করেন।
জেনারেল আজম এবং শেখ মুজিব বুড়িগঙ্গা পার হইয়া কালিগঞ্জ পৌছিলে জনতা বিপুলভাবে তাঁহাদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে। সভা শেষে নেতৃবৃন্দ চলিয়া আসার সময় হাজার হাজার মানুষ খালের দুই ধারে হাততালি ও জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্য দিয়া উল্লাস প্রকাশ করে। জেনারেল আজম নৌকা হইতে ‘চাষীভাই’, ‘জেলে ভাই’ ও ‘কারিগর ভাইদের সালাম জানান। সম্মিলিত বিরােধী দলের কর্মীরা অন্য কয়েকটি নৌকা করিয়া জেনারেল আজমকে বাকল্যান্ড বাঁধে পৌছাইয়া দেয়। বাকল্যান্ড বাঁধে পৌছিলে হকার্স মার্কেটের কয়েক সহস্র কর্মী নেতৃবৃন্দের মােটর গাড়ী ঘেরাও করিয়া শ্লোগান দিতে দিতে সদর ঘাট পর্যন্ত মিছিল করিয়া আসে।
রাত্রি সাতটায় জেনারেল আজম নয়াপল্টনে এক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করেন। শেখ মুজিবর রহমান ও শাহ আজিজুর রহমানও এই সভায় বক্তৃতা করেন।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব