আজাদ
৯ই নভেম্বর ১৯৬৪
বর্তমান শাসকগােষ্ঠির
একটি পরােক্ষ স্বীকৃতির জওয়াবে শেখ মুজিব
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সম্মিলিত বিরােধী দলের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, কনভেনশন মােছলেম লীগের মনােনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এবং তাঁহার অনুচর ও পার্শ্বচরগণ পুনঃ পুনঃ জোর গলায় ঘােষণা করিতেছেন যে, তাহারা পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধন এবং যথাসম্ভব দ্রুত পূৰ্ব্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য দূর করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং এব্যাপারে তাঁহারা নিজেদের দেহ ও মন সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করিয়াছেন। ন্যায়ের খাতিরে আমি বলিতে চাই যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য রহিয়াছে, এতদ্বারা তাহারা উহা স্বীকার করার ন্যায় সততার পরিচয় দান করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের সততা এই পৰ্য্যন্তই।
বৈষম্য দূরকরার বহু বিঘােষিত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক দিক হইতে খোড়া করিয়া রাখা হইয়াছে এবং ইহাকে দ্রুত শিল্পায়িত পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্যদ্রব্যের বাজারে পরিণত করার দুরভিসন্ধির আবরণ হিসাবে ব্যবহার করা হইতেছে। এই সকল ভদ্রলােক সংবাদপত্র, প্রেসনােট ও প্রকাশ্য বিবৃতির সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বহু আড়ম্বরপূর্ণ উন্নয়ন পরিকল্পনা মঞ্জুরের কথা ঘােষণা করিয়া থাকেন। গত ৬ বৎসর যাবৎ আমরা এই সকল ঘােষণার ও পরিকল্পনার কথা অনেক শুনিয়াছি। এই সকল কাগজী-পরিকল্পনার যদি শতকরা ২৫ ভাগও বাস্তবায়িত করা হইত, তাহা হইলে পূর্ব পাকিস্তান আজ অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার স্বর্গে পরিণত হইত এবং আমাদের জীবনযাত্রার মান সুইডেন অথবা আমেরিকার অপেক্ষাও উন্নত হইত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এবং তাহার অনুসারিগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, জনসাধারণের স্মৃতিশক্তি খুবই ক্ষীণ। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এবং যাহারা তাহাকে ঘিরিয়া রহিয়াছেন, তাহারা মনে করেন যে, ইতিহাস শুরু হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ আর কখনও বর্তমানের ন্যায় অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ভােগ করে নাই। এই ধারণা খণ্ডন করার চেষ্টা বাহুল্য মাত্র।
দেশবাসী বর্তমানে দৃষ্টান্তহীন দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কালাতিপাত করিতেছে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিগণ দাবী করিতেছেন যে, পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের শিল্প সমৃদ্ধির জন্য তাহারা অতিমানবীয় ও অলৌকিক কিছু করিয়াছেন। তাহারা দাবী করেন যে, তাহাদের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়ন ক্ষেত্রে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্থানীয় মুদ্রা ব্যয় করা হইয়াছে তাহা তুলনামূলকভাবে অতীতের যে কোন শাসন আমলের চাইতে অনেক বেশী। এ ব্যাপারটি অর্ধসত্য এবং অপরাপর অর্ধ সত্যের মত ইহার উদ্দেশ্য হইল প্রকৃত ও পূর্ণ সত্যকে ঢাকিয়া রাখা।
ইহা সত্য যে, শিল্প খাতে বর্তমানে বৃহত্তর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ােগ করা হইতেছে এবং ঋণগত সুবিধাও বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহার একমাত্র কারণ হইল বর্তমান সরকারের আমলে উল্লেখযােগ্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ হইল যে, বর্তমান সরকার যে সমস্ত শর্তাবলীর অধীনে ঋণ গ্রহণ করিয়াছে কোন গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে তাহা গ্রহণ করা সম্ভবপর হইত না। সরকারী মুখপাত্রের সূত্রে প্রকাশ, অদ্যাবধি যে সকল ঋণ গ্রহণ করা হইয়াছে, ১৯৭০ সাল হইতে বাৎসরিক ৫০ কোটি টাকা হারে সে ঋণ পরিশােধ করিতে হইবে। এই ঋণ পরিশােধের শতকরা ৮০ ভাগ দায়িত্ব পূর্ব পাকিস্তানের। কারণ সে শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব