ইত্তেফাক
৭ই নভেম্বর ১৯৬৪
শেখ মুজিবরের বিবৃতিঃ
পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নে আইয়ুব সরকারের অবদান!
পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নে আইয়ুব সরকারের অবদান সম্পর্কে শেখ মুজিবর রহমান নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়াছেনঃ কনভেনশন মুসলিম লীগ দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও তাঁহার সহযােগীরা পূর্ব পাকিস্তানের সমৃদ্ধির জন্য দেহ, প্রাণ ও মন সমর্পন করিয়াছেন এবং তাহারা সম্ভাব্য স্বল্পাধিক কম সময়ের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান। বৈষম্য নিরসনের জন্য বদ্ধপরিকর রহিয়াছেন- এই কথার পুনরাবৃত্তি করিতে করিতে কান ঝালাপালা করিয়া তুলিয়াছেন। ন্যায়ের খ্যাতিরে আমাকে অবশ্যই বলিতে হইবে যে, তাহারা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য রহিয়াছে তাহা স্বীকার করার মত সততা দেখাইয়াছেন। কিন্তু এইটুকুর মধ্যেই তাঁহাদের সততা সীমাবদ্ধ এবং তাঁহাদের পক্ষে আর বেশীদূর যাওয়া সম্ভব হয় নাই। এই বৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে তাহাদের বহু ঘােষিত প্রচারের মারফৎ পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর পঙ্গু করা এবং দেশের দ্রুত বিকাশমান শিল্পোন্নত অংশ অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার হিসাবে ইহার অবস্থা অপরিবর্তিত ও দৃঢ় রাখার জন্যই ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হইয়াছে। এই সকল ভদ্রলােক প্রায়শঃই প্রেসনােট ও বিবৃতির মারফৎ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নকল্পে জাঁকালাে কর্মসূচী, পরিকল্পনা ও কারখানার জন্য অনুমােদন দানের কথা ঘােষণা করিতেছেন।
কিন্তু মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর চলিয়া গেলেও এই সম্পর্কে পুনরায় আর কিছু শুনা যায় না। বিগত ছয় বৎসর যাবৎ এই ধরনের ঘােষণা দ্বারা আমাদের আপ্যায়িত করা হইয়াছে। এই ধরনের কাগুজে পরিকল্পনার এমনকি শতকরা ২৫ভাগও যদি বাস্তবে পরিণত হইত, তবে পূর্ব পাকিস্তান অনায়াসে ইহার অর্থনৈতিক লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হইত এবং আমাদের জীবনযাত্রার মান সুইডেন অথবা আমেরিকাকে ছাড়াইয়া যাইত। জনসাধারণের স্মৃতি শক্তি যে স্বল্পস্থায়ী, তাহা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও তাঁহার বন্ধুবান্ধব একান্তভাবেই বিশ্বাস করেন।
ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও তাহার পার্শ্বচরগণ মনে করেন যে, তাঁহার মহান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে সমৃদ্ধি ভােগ করিতেছে, ইতিহাসে আর তাহা কোনদিন ঘটে নাই। এই ধরনের অভিমত খণ্ডনের কোন প্রয়ােজন নাই। আমাদের জনগণ বর্তমানে যে দুর্দশার মধ্যে কালাতিপাত করিতেছে তাহার কোন নজির নাই। ক্ষমতাসীন মহল দাবী করিতেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নের জন্য তাঁহারা অতিমানবিক ও অতিপ্রাকৃতিক কাজ করিয়াছেন। তাঁহারা দাবী করিতেছেন যে, পূর্ববর্তী সরকার সমূহের তুলনায় তাঁহাদের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়নের জন্য বৈদেশিক ও স্থানীয় মুদ্রায় অনেক বেশী গুণ অর্থ ব্যয় করা হইয়াছে। ইহা শুধু অর্ধ সত্য এবং সকল অর্ধ সত্যের ন্যায় প্রকৃত ও পুরা সত্যকে চাপা দেওয়াই ইহার উদ্দেশ্য।
আসল কারণ কি
ইহা সত্য যে, এখন বৈদেশিক মুদ্রার মােটা অংশ শিল্পোন্নয়নের জন্য পাওয়া যায় এবং ঋণদানের সুযােগ-সুবিধা ও সম্প্রসারিত হইয়াছে। বর্তমান সরকার কর্তৃক বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলেই তাহা ঘটিয়াছে। তাহারা বলিতেছেন যে, তাহাদের দ্বারা সাধিত স্থিতিশীলতার জন্য ইহা সম্ভব হইয়াছে। এই বহু কথিত স্থিতিশীলতা সম্পর্কে আমি আলােচনা করিতে চাই না।
এই বৈদেশিক সাহায্যের বৃদ্ধির আসল কারণ এই যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল যে শর্তে অনায়াসে এই সাহায্য গ্রহণ করিয়াছেন, কোন গণতান্ত্রিক সরকার তাহা করিতে সাহসী হইতেন না।
বৎসরে ৫০ কোটি টাকা সুদ
জনৈক সরকারী মুখপাত্রের মতে এ পর্যন্ত গৃহীত ঋণের জন্য ১৯৭০ সাল হইতে আমাদের বৎসরে ৫০ কোটি টাকা সুদ পরিশােধ করিতে হইবে। এই ঋণ পরিশােধের শতকরা ৮০ভাগ বােঝাই পূর্ব পাকিস্তানকে বহন করিতে হইবে। কারণ, শতকরা ৭৫ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানই অর্জন করে। সাহায্য বাবত প্রাপ্ত এই অর্থের শতকরা ২০ ভাগও পূর্ব পাকিস্তান পাইতেছে না। কাজেই প্রকৃত চিত্র এইরূপ দাঁড়াইতেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানকে বন্ধক দিয়া এই ঋণ নেওয়া হইতেছে আর ঋণের শতকরা ৮০ ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে পূর্ব বঙ্গে এই সাহায্যের সামান্যতম ব্যয় সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়নের উদ্দেশ্যে মঞ্জুরীকৃত অর্থের পরিমাণ গাণিতিকভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। কিন্তু এই বৃদ্ধির দ্বারা শুধু ফাঁসি-রজ্জুকেই দৃঢ় করা হইয়াছে।
প্রকৃত পক্ষে সমগ্র ব্যাপারটাই পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়ন ব্যাহত করার জন্য একটি সুচতুর ত্রিমুখী পরিকল্পনার সামিল। এই পরিকল্পনার সঙ্গে ৩টি পক্ষযথা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সরকার, পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের একটি ক্ষুদ্র চক্র এবং বৈদেশিক ঋণদান সংস্থাসমূহ ও তাহাদের বিশেষজ্ঞগণ জড়িত রহিয়াছেন।
কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পরিকল্পনা ও বাহ্যতঃ জাঁকালাে অর্থনৈতিক বরাদ্দসমূহ প্রকাশ করিয়া থাকেন। অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকরীকরণের জন্য এই কর্মসূচী ও পরিকল্পনার চূড়ান্ত অনুমােদন দেওয়া হয়। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনমতকে পরিতুষ্ট করিয়া এই পরিকল্পনাসমূহ বানচাল অথবা বিলম্বিত করার উদ্দেশ্যে পর্দার অন্তরালে ঋণের ব্যাপারে ছলচাতুরী শুরু হয়। কতিপয় নজির হইতে এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের স্বরূপ ধরা পড়িবে।
কতিপয় পরিকল্পনার পরিণতি
প্রায় ২ বৎসর পূর্বে রূপপুরে একটি আণবিক চুল্লী নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমােদন করা হয়। এখন মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা উক্ত চুল্লীর জন্য প্রয়ােজনীয় সাহায্য প্রত্যাহার করিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। এই পরিকল্পনা। সম্পর্কে বর্তমানে আর কিছু শােনা যাইতেছে না।
তিন বৎসর পূর্বে বন উন্নয়ন কর্পোরেশনের কাষ্ঠ আহরণ পরিকল্পনার অনুমােদন দেওয়া হয়। কিন্তু ঋণপ্রাপ্তির অসুবিধার জন্য এই পরিকল্পনার কার্যকরীকরণ মরীচিকাময় হইয়া রহিয়াছে।
সিলেটে ঘাস হইতে কাগজ প্রস্তুতের জন্য কল নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটিয়াছে। চলতি বৎসরের প্রথম দিকে এই পরিকল্পনাটি অনুমােদন করা হয়; কিন্তু অনুমােদন দানের সময়ে ঋণের ব্যাপারে কোন আভাস না থাকায় এখন পর্যন্ত এই পরিকল্পনার কোন অগ্রগতি হয় নাই। এই পরিকল্পনার জন্য এখন মার্কিন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা কর্তৃক ঋণ মঞ্জুর করা হইয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার ঋণদান পদ্ধতির জটিলতার জন্য এখনও এই ব্যাপারে কোন চূড়ান্ত ফয়সালা হয় নাই এবং পরিকল্পনা কখন প্রকৃতপক্ষে বাস্তবরূপ লাভ করিবে তাহা বুঝা যাইতেছে না।
পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি ও শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে সার ও গ্যাস শিল্প নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বর্তমান জনসংখ্যার জন্য অত্যন্ত অপর্যাপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান কৃষি সম্পদ উন্নয়নের যে-কোন চিন্তা আমাদের কৃষকদের সার সরবরাহের মাধ্যমে শুরু করিতে হইবে। সৌভাগ্যবশতঃ এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে, পূর্ব পাকিস্তান গ্যাসের ব্যাপারে এত সমৃদ্ধ যে, এই সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার দ্বারা শুধুমাত্র আগামী শত বৎসরের জন্য আমাদের শিল্পসমূহের বিদ্যুৎ সরবরাহ সমস্যার সমাধানই হইবে না, বরং আমাদের সারের প্রয়ােজন পুরাপুরি মিটিয়া প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ব্যাপারে অনেক সার উদ্বৃত্ত থাকিয়া যাইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের বহু বৎসর আগে সিলেটে গ্যাস পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প এবং এমনকি গৃহিণীরা পর্যন্ত যেখানে সুইগ্যাসের সুবিধা ভােগ করিতেছে সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে পাইপ লাইন বসানাের কাজ প্রাথমিক পর্যায়ও অতিক্রম করে নাই। পার্লামেন্টারী শাসনামলের শেষভাগে ফেঞ্চুগঞ্জে নির্মিত সার কারখানা বিরাটভাবে সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে আগ্রহশীল যে কেহ যথাসম্ভব দ্রুত যত বেশী সার কারখানা নির্মাণ করা যায় প্রতি অধিকতর মনােযােগী হইবেন। ঘােড়াশালে একটি সার কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা দুই বৎসরের উপর বিবেচনাধীন থাকার পর কেন্দ্রীয় সরকার এক বৎসরেরও আগে পরিকল্পনাটি চূড়ান্তভাবে অনুমােদন করেন। কিন্তু ঋণদানের এই সর্পিল ধাধা এই ক্ষেত্রেও কাজ করিয়াছে। এই ব্যাপারের সর্বশেষ অবস্থা দাড়াইয়াছে এখন, এইজন্য প্রয়ােজনীয় ঋণ দানের দায়িত্ব এখন বিশ্বব্যাঙ্কের উপর পড়িয়াছে এবং যাহার অর্থ হইতেছে এই কারখানা নির্মাণ করিতে কমপক্ষে ৫বৎসর বিলম্ব হইবে। এই কারখানার জন্য জাপান সরকার ইয়েন ঋণ দিতে সম্মত ছিলেন বলিয়া খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু সম্প্রতি টোকিও সফরকালে আমাদের সরকারী প্রতিনিধিরা তাহাতে আপত্তি করেন। ইয়েন ঋণ দ্বারা ঘােড়াশাল সার কারখানা নির্মাণের কাজ যথেষ্ট তরান্বিত হইত। ট্রিপল সুপার ফসফেট কারখানার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ঘটিয়াছে।
পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি জীবনে রাসায়নিক সারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি এ বৎসরও কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ৩ কোটি টাকার উপর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করিয়া ৬০ হাজার টনের উপর ট্রিপল সুপার ফসফেট আমদানী করিয়াছে। গত বৎসর এই কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমােদন করা হয়। এবং তাহার পর আন্তর্জাতিক সহযােগিতা সংস্থার সেরেস্তায় এই পরিকল্পনার কাগজপত্রের উপর ধূলা জমিতেছে। এই পরিকল্পনাটি কখনও কার্যকরী হইবে কিনা, তাহা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এই প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করিতে পারি যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের সম্ভাবনা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে জরিপের জন্য পরিকল্পনা কমিশন পশ্চিম জার্মানীর ইমহাউসেন কোম্পানীকে নিয়ােগ করে। উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পেশকৃত রিপাের্টে পূর্ব পাকিস্তানে সার ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প স্থাপনের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে সুপারিশ করা হইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে গ্যাস পরিমাণে বেশী, বিশুদ্ধ ও ইহা সস্তায় আহরণ করা যায়। এই রিপাের্টটি এখন ‘হিমাগারে’ সংরক্ষিত রাখা হইয়াছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে দ্রুত পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প বিকাশের পরিকল্পনা কার্যকরী করিতে অগ্রসর হইয়াছেন। পাট শিল্পের ইতিবৃত্তই সবচাইতে চমৎকার।
১৯৫০ হইতে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের পাট শিল্পে প্রদেশের গুটিকয়েক ধনী পরিবারের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। এই এগার বৎসর পূর্ব পাকিস্তানের জনমত বারম্বার পাট শিল্পের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙ্গার জোর দাবী জানাইয়া আসিয়াছে। কিন্তু দেশের শীর্ষ স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদিগণ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত পাটশিল্প এই জনমতের দাবী দাবাইয়া রাখিতে সক্ষম হয় এবং দরিদ্র পাটচাষীদের রক্ত পানি করা শ্রমের বিনিময়ে অবিশ্বাস্য রকমের মুনাফা অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে তাহারা পাট শিল্পের সম্প্রসারণকেই রুদ্ধ করিয়া রাখে। ১৯৬২ সালে সরকার পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রতি উপেক্ষার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনমতের প্রবল চাপের নিকট নতি স্বীকার করেন এবং পাট শিল্প সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের এই শিল্পে অর্থ বিনিয়ােগের সুযােগদানের উদ্দেশ্যে একটি ফর্মুলা প্রণয়ন করা হয়। প্রস্তাবিত এক কোটি ৫০ লক্ষ টাকার পুঁজির মধ্যে ১কোটি টাকা আইডিবিপি, ২৫ লক্ষ টাকা পুঁজি বিনিয়ােগকারী এবং ১০ লক্ষ টাকা সরকার কর্তৃক প্রদত্ত হইবে বলিয়া স্থির হয়। অপর ১০ লক্ষ টাকার দায়িত্ব সরকার ও সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতিগণ গ্রহণ করেন। এই নীতির ফলে শীঘ্রই ২৫০টি তাঁত বিশিষ্ট প্রায় এক ডজন পাট কলে উৎপাদন শুরু হইবে। ইহা নিঃসন্দেহে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ঘাটতি পূরণের জন্য বিরাটভাবে সহায়ক হইবে। এই ১২টি পাটকলের উদ্যোক্তাগণ সকলেই এই প্রদেশের খাঁটি বাসিন্দা। স্বভাবতঃই প্রদেশের বাসিন্দা নহেন এমন বড় ব্যবসায়ীদের নিকট এই পরিকল্পনা গ্রহণযােগ্য হয় নাই। তাহারা এই ফর্মুলা বানচাল করিবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালাইয়া আসিতেছিলেন। অবশেষে বিশ্বব্যাঙ্ক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সহযােগিতায় তাঁহাদের এই মতলব হাসিল হইতে চলিয়াছে বলিয়া মনে হয়। আমি জানিতে পারিয়াছি যে, পূর্ব পাকিস্তানে পাট শিল্প প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর করতলগত প্রতিষ্ঠান পিকইক-এর নিকট হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকারও নাকি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, অন্ততঃ এক হাজার তাঁত না থাকিলে কোন পাট কলের জন্য সাহায্য মঞ্জুর করা হইবে না। এরদ্বারা পাট শিল্প হইতে পূর্ব পাকিস্তানিগণ সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হইবে। গত বত্সর জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল ৮টি শিল্প ইউনিটের জন্য ২ হাজার তাঁত মঞ্জুর করেন। এবং মাত্র সেদিন আরও ২হাজার তাঁত মঞ্জুর করা হইয়াছে। কিন্তু আমরা যতদূর জানি পূর্ববর্তী ৮টি ইউনিটের মধ্যে মাত্র দুটি এলসি খােলা পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছে এবং অপরগুলি বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে ‘শিকায় ঝুলিতেছে। এতদিন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ দ্বারা পাট শিল্পের পুঁজি জোগান হইতেছিল। কিন্তু এক্ষণে সে অর্থ অন্যখাতে বরাদ্দ করিয়া পাট শিল্পকে সম্পূর্ণরূপে পিকিক এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের আঁতাতের খপ্পরে ফেলা হইতেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ শিল্প পরিবারগুলির হাতে পাট শিল্পকে তুলিয়া দেওয়াই যে এই কারসাজির উদ্দেশ্য তাহা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। এক বৎসরের অধিককাল পূর্বে কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী ঘােষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ১০০০ বৃহদায়তন তাঁত বরাদ্দ করা হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প বিভাগীয় ডিরেক্টর এবং ইপিআইডিসি ২৫ এবং ৫০টি তাঁত বিশিষ্ট শিল্প ইউনিট স্থাপনের উদ্যোক্তাদের নিকট হইতে দরখাস্ত আহ্বান করিয়া বিজ্ঞাপন প্রদান করেন। এই ইউনিটগুলিকে নগদ বৈদেশিক মুদ্রা মঞ্জুর করার কথা ছিল। সেই সকল দরখাস্ত তখন হইতে ফাইলে পচিতেছে এবং এতদিনে হয়ত উহা উঁইপােকায় খাইয়া শেষ করিয়া দিয়াছে।
পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিলম্বের অজুহাত হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার অসুবিধার কথা বলা হইলেও পশ্চিম পাকিস্তানের বেলায় সে অসুবিধা দেখা যায় না। এমনকি জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলে পরিকল্পনাটি পাস হওয়ার পূর্বেই পশ্চিম পাকিস্তানের চিনিকল, পাটকল ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের কলকজার জন্য বিদেশে ফরমায়েশ দেওয়া হইয়াছে।
৮ বৎসর অবিরাম সংগ্রামের পর পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সামান্য কিছুটা অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ সাধিত হইয়াছিল এবং উহার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য এবং শিল্প উদ্যোগও শুরু হইয়াছিল। কিন্তু নয়া শাসকগণ প্রথম হইতেই এই শিল্প উদ্যোগকে খতম করার জন্য সংকল্পবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাইতে থাকেন। তাহারা সঙ্গে সঙ্গে “শিল্পে পুঁজি বিনিয়ােগের অনুকূল পরিবেশের সুযােগ গ্রহণের জন্য পঃ পাকিস্তানী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করিতে থাকেন। পক্ষান্তরে তাহারা পঃ পাকিস্তানকে সর্বাধিক পরিমাণ ঋণের সুযােগ-সুবিধা দেওয়ার জোর চেষ্টা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানকে কেবল কতকগুলি কাগুজে পরিকল্পনা দিয়া সন্তুষ্ট করা হয়, যাহা কোনদিনই বাস্তবায়িত হইবার নয়। এই সরকার সর্বপ্রথম, করদাতাদের অর্থে প্রতিষ্ঠিত কর্ণফুলি কাগজের কল প্রায় বিনামূল্যে দাউদ পরিবারের হাতে তুলিয়া দেন। অথচ আমাকে ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর তারিখে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কন্ট্রাক্ট প্রদানের ব্যাপারে নিয়ম লংঘনের অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়। যদিও আদালতে এইসব অভিযােগের কোনটাই প্রমাণিত হয় নাই। কিন্তু কর্ণফুলী কাগজ কল বিক্রির জন্য কোন টেণ্ডার আহ্বান করা হয় নাই- পূর্ব পাকিস্তানের একটি সরকারী সম্পত্তি বেসরকারী হস্তে তুলিয়া দেওয়া হয় এবং উহার সকল লেনদেন পর্দার অন্তরালেই অনুষ্ঠিত হয়। দাউদ পরিবারের প্রতি বর্তমান সরকারের বদান্যতা এখানেই শেষ হয় নাই- চট্টগ্রামের বিশাল অরণ্য এলাকা দাউদ পরিবারকে অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণ মাশুলের বিনিময়ে তাহাদের নিয়া রেয়ন মিলের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য ‘লীজ দেওয়া হইয়াছে।
কালিরগঞ্জের মসলিন কটন মিল এবং খুলনার প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল মিয়া বশির এবং আদমজীকে দেওয়ার উদ্যোগ গৃহীত হয়। কিন্তু জনমতের চাপে শেষ মুহূর্তে এই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। তৈল পরিশােধনাগার সরকারী এখতিয়ারে না রাখিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের রাঘব-ব্যবসায়ীদের হাতে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। ইস্পাত কারখানাটিরও একই গতি করার উদ্যোগ চলিতেছিল কিন্তু জনমতের চাপে তাহাও শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হইয়াছে। ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ঘােষণা করিয়াছিলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যাপারে তদন্ত করিয়া দ্রুত প্রতিবিধানের সুপারিশ করার জন্য তিনি একটি অর্থনৈতিক কমিশন গঠন করিবেন। একটি কমিশন সত্যই গঠিত হয়। কিন্তু উহার রিপাের্ট কখনও দিবালােকের মুখদর্শন করে নাই। কিন্তু কেন? ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান অনুগ্রহ করিয়া ইহার জবাব দিবেন কি? ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব এবং তাঁহার সহযােগিগণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে যদি সত্যিই আগ্রহী হইয়া থাকেন তাহা হইলে উক্ত কমিশনের বিপাের্ট কেন প্রকাশ করা হইল না এবং কেন উহার সুপারিশসমূহ কার্যকরী করা হইল না?
এইরূপ আরও শত শত উদাহরণ দেওয়া যায়। গােয়েবলসীয় কৌশলে মিথ্যাকে বারম্বার সত্য বলিয়া প্রচার করার ফলে সৃষ্ট ধূম্রজালের অন্তরালে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপরীত গীয়ারে অগ্রগতি লাভ করিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি-সচেতন জনসাধারণ ধূম্রজাল ভেদ করিয়া এসত্য দর্শন করিয়াছে। আমি পূর্ব পাকিস্তানের মত পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারেও সমভাবে উৎসাহী। আমি একথাও জানি যে, পশ্চিম পাকিস্তানে যে সকল অর্থনৈতিক উন্নয়ন হইয়াছে, তাহার সুফল গুটিকয়েক পরিবারই ভােগ করিতেছে। এবং প্রকৃতপক্ষে উহার কিছুই জনসাধারণ পর্যন্ত পৌছায় নাই। আজ পূর্ব পাকিস্তানে গণজাগরণ সৃষ্টি হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ উভয় প্রদেশের নির্যাতীত জনসাধারণের মুক্তি সাধনের সংগ্রামে অগ্রদূত হিসাবে গর্ববােধ করিবে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব