You dont have javascript enabled! Please enable it!

আজাদ
২৩শে অক্টোবর ১৯৬৪

খওয়াজা নাজিমুদ্দিনের এন্তেকাল-হইয়া পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম বীর
আজমের মৃত্যু সংবাদে দেশবাসী শােকে মুহ্যমান

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সেনানী খওয়াজা নাজিমুদ্দীন গতকল্য বৃহস্পতিবার ঢাকায় এন্তেকাল করিয়াছেন (ইন্নালিল্লাহে … রাজেউন)। সন্ধ্যা ৫টা ৪৫ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় প্রবীণ জননায়ক তাঁহার নিউ ইস্কাটনস্থ বাসভবনে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে মরহুমের বয়স ৭১ বৎসর হইয়াছিল। সম্মিলিত বিরােধী দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা খওয়াজা নাজিমুদ্দীনের মৃত্যু সংবাদ বিদ্যুৎ বেগে ছড়াইয়া পড়ে এবং শহরের সর্বত্র শােকের গভীর কালাে ছায়া নামিয়া আসে। সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণ মৃত্যুর পরমুহূৰ্ত্ত হইতেই মরহুমের ইস্কাটন রােডস্থ বাসায় উপস্থিত হইয়া বিদেহী রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। পরলােকগত নেতাকে শেষবারের মত দেখার জন্য সারারাত্রি হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভীড় করিতে থাকে।
স্থানীয় রাজনৈতিক মহল খওয়াজা নাজিমুদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যুকে রাষ্ট্রের সঙ্কট মুহূর্তে ‘মারাত্মক ও অপূরণীয় জাতীয় ক্ষতি’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। সম্মিলিত বিরােধী দলের মনােনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্না ছয়টা দশ মিনিটের সময় এই দুঃসংবাদ জানা মাত্রই খওয়াজা সাহেবের গৃহে উপস্থিত হন এবং মরহুমের শয্যা পার্শ্বে ফাতেহা পাঠ করেন। অদ্য শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিকাল তিনটায় আউটার ষ্টেডিয়ামে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হইবে বলিয়া ঘােষণা করা হইয়াছে। মৃত্যুকালে তাঁহার শয্যা পার্শ্বে স্ত্রী, ভ্রাতা খওয়াজা শাহাবুদ্দীন, পুত্র খওয়াজা মহিউদ্দিন, কন্যা বেগম জাফর বানাে ও এক নাতনী উপস্থিত ছিলেন। আল্লার নাম করিতে করিতে স্বীয় ভ্রাতা খওয়াজা শাহাবুদ্দিনের কোলে মাথা রাখিয়া তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মরহুম দুই পুত্র, এক কন্যা ও বৃদ্ধা স্ত্রী সহ বহু আত্মীয়স্বজন রাখিয়া গিয়াছেন। খওয়াজা নাজিমুদ্দীন কায়েদে আজমের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের গবর্ণর জেনারেল নিযুক্ত হন। অতঃপর কায়েদে মিল্লাতের মৃত্যুতে উজিরে আজমের পদ শূন্য হইলে তিনি উক্ত পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের উজিরে আলা হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। খওয়াজা ছাহেব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। গতকল্য বৈকাল পাঁচটা পর্যন্ত খওয়াজা ছাহেব সম্পূর্ণরূপে সুস্থ ছিলেন। বেলা সাড়ে চারটার সময় প্রদেশের সাবেক গবর্ণর লেঃ জেনারেল আজম খান তাহার বাসভবনে গমন করিলে তিনি আসন্ন নির্বাচন ও বিরােধী দলের কার্যক্রম সম্পর্কে আলােচনা করেন। তিনি তাঁহার সহিত আলােচনাকালে বিকাল ৫টার সময় হঠাৎ অস্বস্তি অনুভব করেন এবং হৃদরােগে আক্রান্ত হইয়াছেন বলিয়া আশঙ্কা করা হয়।
তিনি অসুস্থ হওয়ার পরও জেনারেল আজম দশ মিনিটকাল তাহার পাশে ছিলেন এবং খওয়াজা সাহেবকে বিশ্রাম নিতে বলিয়া তিনি চলিয়া আসেন। এই সময় হৃদরােগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইব্রাহিমকে ডাকিয়া পাঠান হয়। ডাঃ ইব্রাহিম তাঁহার গৃহে আগমন করিয়া তাহাকে পরীক্ষা করেন এবং খওয়াজা ছাহেব হৃদরােগে আক্রান্ত হইয়াছেন বলিয়া প্রকাশ করেন। এই সময় হৃদরােগের অতি প্রয়ােজনীয় ঔষধ না থাকায় তিনি তৎক্ষণাৎ উহা আনয়নের উদ্দেশ্যে হাসপাতালে ছুটিয়া যান। কিন্তু হাসপাতাল হইতে ঔষধ লইয়া প্রত্যাবর্তনের মাত্র দুই মিনিট পূৰ্বেই গণতন্ত্রের এই বীর সেনানী চির দ্রিার কোলে ঢলিয়া পড়েন। খওয়াজা নাজিমুদ্দীনের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং গণতন্ত্রের জন্য তাহার অকৃত্রিম সংগ্রামের ফলেই দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়। কিছুদিন পূর্বে খওয়াজা ছাহেব উদ্যোগী হইয়া দেশের বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক আহ্বান করেন এবং সেখানেই গঠিত হয় সম্মিলিত বিরােধী দল।
খওয়াজা নাজিমুদ্দীনের মৃত্যুতে দেশবাসী প্রাচীন রাজনীতিকদের মধ্যে সকলের চাইতে প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও গণতন্ত্রের আজীবন পতাকাবাহী এক শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিককে হারাইল। মৃত্যু সংবাদ টেলিফোন, বেতারের স্থানীয় খবরে ও লােকমুখে শহরের সমস্ত এলাকায় দ্রুতগতিতে ছড়াইয়া পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, উচ্চপদের সরকারী কর্মচারী, আইনবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, যুব ও নারী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধিগণ খওয়াজা ছাহেবের নয়া ইস্কাটন রােডস্থ গৃহে উপস্থিত হইয়া শােকাভিভূত হইয়া পড়েন।
প্রাদেশিক গবর্ণর জনাব মােনায়েম খান এই মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া রাত্রি সাতটার পর সন্ত্ৰীক খওয়াজা ছাহেবের বাড়ীতে গমন করেন। তিনি খওয়াজা ছাহেবের পুত্র ও ভ্রাতা খওয়াজা শাহাবুদ্দিনের নিকট শােক প্রকাশ করেন এবং আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। গবর্ণর ছাহেব মরহুমের লাশের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আত্মার মাগফেরাত কামনা করিয়া মােনাজাত করেন। খওয়াজা ছাহেবের শােকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনের নিকট সমবেদনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে জনাব নুরুল আমীন, জেনারেল আজম খান, কে, এইচ, খুরশীদ, সাবেক বিচারপতি মােহাম্মদ ইব্রাহীম, জনাব আবুল মনসুর আহমদ, জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব আবুল কাসেম, জনাব শফিকুল ইসলাম, মওলবী ফরিদ আহমদ, শেখ মুজিবর রহমান, ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান, প্রাদেশিক স্পীকার জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরী, অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, অধ্যাপক গােলাম আজম, মওলানা মােসলেহ উদ্দিন, বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, সাবেক উজির জনাব ফজলুর রহমান, অর্থ উজির জনাব হাফিজুর রহমান, জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া), জনাব আখতার উদ্দিন, বেগম রােকাইয়া আনােয়ার ও প্রাদেশিক উজিরগণ ইস্কাটনের শােকাচ্ছন্ন বাড়ীতে গমন করেন।
চতুর্দশ ডিভিশনের কম্যান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান, প্রাদেশিক চীফ সেক্রেটারী জনাব আলী আসগর ও আই জি পি জনাব কবীর খওয়াজা ছাহেবের বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া শােক প্রকাশ করেন।
বিভিন্ন স্থানে প্রতিক্রিয়া
করাচী, ২২শে অকটোবর। সম্মিলিত বিরােধী দলের করাচী কমিটি অদ্য এক বৈঠকে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় আলােচনা করার সময় খওয়াজা নাজিমুদ্দিনের মৃত্যুর সংবাদ পাইয়া সঙ্গে সঙ্গে আলােচনা স্থগিত রাখে এবং উক্ত সভা শােকসভায় পরিণত হয়। সভায় কাউন্সিল মােছলেম লীগ প্রধানের মৃত্যুতে শােক প্রকাশ করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।
করাচী আঞ্চলিক কাউন্সিল লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব রিজওয়ান আহমদ এবং কোষাধ্যক্ষ জনাব হারুন আহমদ খওয়াজা ছাহেবের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন।
চট্টগ্রামে শােকের ছায়া
চট্টগ্রাম, ২২শে অকটোবর।- অদ্য সন্ধ্যায় খওয়াজা নাজিমুদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদে চট্টগ্রামবাসী শােকে মূহ্যমান হইয়া পড়ে। এই সংবাদের পরই মওলবী নূর আহমদের মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ায় জনগণ আরও শােকাভিভূত হইয়া পড়ে।- এ, পি, পি।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!