আজাদ
১৬ই অক্টোবর ১৯৬৪
অশ্রুতপূর্ব গণ-সম্বর্ধনা ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ততার জোয়ার
(স্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য বৃহস্পতিবার প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার চতুপার্শ্বে স্বতঃস্ফূর্ততার যে জোয়ার আসিয়াছিল তেজগাঁও বিমান বন্দরে তাহা প্রতিহত হয়। লাখাে কণ্ঠের জিন্দাবাদ ধ্বনি আর মুহুর্মুহু করতালিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত ও বিমােহিত হইয়া উঠিয়াছিল। বিরােধী দলের মনােনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাকে সম্বৰ্ধনা জ্ঞাপনের জন্য গতকল্য (বৃহস্পতিবার) বিমানবন্দর ও ময়মনসিংহ রােডে লক্ষাধিক নরনারী ও শিশু উপস্থিত হয়। এই ঐতিহাসিক সম্বৰ্ধনায় নিচ্ছিদ্র জনতার মধ্য দিয়া মিস জিন্নাকে রাজধানীর ষ্টেট গেষ্ট হাউস পর্যন্ত আসিতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন জনসাধারণ বিমান বন্দর হইতে শহর পর্যন্ত তিনমাইল দীর্ঘ পথ ব্যাপী মাদারে মিল্লাতকে পুষ্পকোরক ও গােলাপপানি বর্ষণ দ্বারা খােশ আমদেদ জানান।
বেলা একটায় গেষ্ট হাউসে প্রবেশের পূৰ্ব্বে মিস জিন্না বিরােধী দলের উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে লইয়া শেরে বাংলা ও সােহরওয়ার্দীর মাজারের সম্মুখে ফাতেহা পাঠ করেন।
“মাদারে মিল্লাত জিন্দাবাদ, একনায়কত্ববাদ বরবাদ হউক”, “গণতন্ত্র জিন্দাবাদ” শ্লোগানের মধ্যে গতকল্য বেলা সাড়ে দশটার সময় মিস জিন্নাসহ করাচী হইতে আগত পি, আই, এ বিমানটি ঢাকা বিমান বন্দরের রানওয়েতে উপস্থিত হয়। আনন্দ ও উচ্ছাসে উদ্বেলিত দর্শনপ্রার্থী হাজার হাজার মানুষের ভিড় হইতে তাঁহাকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার উদ্দেশ্যে মিস জিন্নাহসহ বিমানটি বিমান বন্দরের অভ্যন্তরে আনা হয় নাই। একটি বিশেষভাবে সজ্জিত ট্রাকের উপর নির্মিত মঞ্চের আয়ােজন পূৰ্বেই করা হইয়াছিল। সম্বর্ধনার উদ্যোক্তাগণ রানওয়েতেই উক্ত ট্রাকের মঞ্চের উপর মাদারে মিল্লাতকে নামাইয়া আনেন। মঞ্চসজ্জিত ট্রাকটি মিস জিন্নাকে লইয়া হেলিপাের্টের নিকট উপস্থিত হইলে মূল বিমান বন্দরে অপেক্ষমান বিপুল জনতা সেই দিকে ধাবিত হয় এবং মুহূর্তের মধ্যে শ্লোগানমুখর জনসমুদ্রের মাঝে গাড়ীটি আটক হইয়া পড়ে।
মিস জিন্নার গাড়ীর মঞ্চের উপর একপাশে মওলানা ভাসানী মধ্যভাগে এই প্রদেশের সাবেক গবর্ণর লেঃ জেনারেল আজম খান এবং অপর পাশে শেখ মুজিবর রহমান উপবিষ্ট ছিলেন। তদুপরি বিরােধী দলের নেতৃবর্গ মওলানা তর্কবাগীশ, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, মৌলবী ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গােলাম আজম, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় উজির জনাব ফজলুর রহমান, জনাব এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, বেগম রােকেয়া আনােয়ার ও বেগম বি আহমদ প্রমুখ সম্বৰ্ধনার দুইটি গাড়ীতে ছিলেন। মিস জিন্নার গাড়ির পিছনেই ছিল সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট একটি ভিন্ন গাড়ী।
সৰ্ব্বপ্রথম সম্মিলিত বিরােধী দলের অঙ্গদলগুলির প্রতিনিধি নেতৃবর্গ মিস জিন্নাকে বিমান হইতে অবতরণের পরেই বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করেন।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ও তেজগাঁও-এর বিভিন্ন শ্রমিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠান, মহিলা সম্বৰ্ধনা কমিটি এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহের পক্ষ হইতে ট্রাকের মঞ্চের উপর উপবিষ্ট মাদারে মিল্লাত মিস জিন্নাকে পুষ্পমাল্য ও পুষ্পস্তবক দেওয়া হয়। সমগ্র বিমান বন্দর এলাকায় সকাল দশটা হইতেই ট্রাফিক প্রায় বন্ধ হইয়া যায় তিনটি শ্রমিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে ব্যান্ডপার্টি দ্বারা মিস জিন্নাকে সম্বর্ধনা জানান হয়।
বিমান বন্দর হইতে মােহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নাকে লইয়া যখন ট্রাকটি বিমান বন্দরের প্রধান তােরণ হইতে এয়ারপাের্ট রােডে উপস্থিত হয় তখন প্রখর রৌদ্রে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার ঘর্মাক্ত কলেবর নরনারী গণতন্ত্রের মশালবাহী এই মহিয়সী মহিলাকে নিকটতম স্থান হইতে দেখিবার জন্য উদ্বেল হইয়া উঠেন। তাঁহারা গগনবিদারী কণ্ঠে মুহুর্মুহুঃ ধ্বনি দিতে থাকেন । মাদারে মিল্লাত জিন্দাবাদ, গণতন্ত্র জিন্দাবাদ, ভােটাধিকার দিতে হবে, একনায়কত্ব বরবাদ হােক, আজম খান জিন্দাবাদ। বিরাটাকার ট্রাকের উপর নির্মিত মিনারের উপর একটি আসনে সমাসীন হইয়া মােহতারেমা মিস জিন্না গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যগ্র জনতার উল্লাস দেখিয়া আনন্দ লাভ করেন। তাঁহার তুষারশুভ্র কেশগুচ্ছ এবং শ্বেত শুভ্র পােশাকের উপর সূর্যরশ্মি বিকীরণ করায় যে দ্যুতি বিচ্ছুরিত হইতেছিল, তাহাতে তাঁহাকে মহিমময়ী করিয়া তুলিয়াছিল। মৃদু বাতাসে তাঁহার শুভ্র কেশ গুচ্ছ মাঝে মাঝে উড়িয়া পড়িতেছিল। লক্ষ মানুষের কণ্ঠে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবী মুহুর্মুহুঃ গৰ্জন করিয়া উঠার সময় আত্ম প্রত্যয়ের দৃঢ়তায় তাঁহার শীর্ণ মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছিল।
ট্রাকটি অতি ধীরে অগ্রসর হইতে থাকে। রাস্তার দুই পার্শ্বে এবং পার্শ্ববর্তী গৃহগুলির বারান্দা ও ছাদে অধৈৰ্য্য নর-নারী মিস জিন্নাকে দর্শনের জন্য সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান থাকেন। ট্রাকটি ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়ার সময় মাঝে মাঝে উল্লসিত জনতা করতালি দিয়া প্রিয় নেত্রীকে অভ্যর্থনা জানান।
মিস জিন্নাহর শােভাযাত্রাটির সম্মুখে একটি ব্যান্ড পার্টি’ মােহতারেমার আগমন বার্তা ঘােষণা করিয়া আগে আগে চলিতেছিল।
রাস্তার দুই পার্শ্বে এবং শােভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী জনতার উল্লাস দেখিয়া মনে হইতেছিল, জনসাধারণ যেন পথের দিশারী খুজিয়া পাইয়াছেন তাই তাহারা এক অনাস্বাদিত আনন্দে উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছেন।
ক্ষুদ্র বালক-বালিকা পৰ্য্যন্ত এইদিন রাস্তার দুইপার্শ্বে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াইয়া থাকে।
ঢাকা শহর মহিলা অভ্যর্থনা কমিটির পক্ষ হইতে বাংলা একাডেমীর সম্মুখে সম্বৰ্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। কয়েকশত মহিলা সকাল ১০টা হইতে মােহতারেমার আগমন প্রত্যাশায় খররৌদ্রের মধ্যে অপেক্ষা করিতেছিলেন। এই মহিলারা সম্পূর্ণভাবে পূর্ব পাকিস্তানের পল্লী জীবনের প্রতিফলন করিয়া যে সুরুচিপূর্ণ তােরণ নির্মাণ করেন তাহা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু তােরণটির উচ্চতা কম থাকার জন্য মােহতারেমার ট্রাকখানি উহার ভিতর দিয়া গমন করিতে পারে না। সেই জন্য উহা ভাঙ্গিয়া ফেলা হয়। মহিলাদের তােরণদ্বারে মিস জিন্নাহকে আগমন করিতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। মহিলাগণ মিস জিন্নাহকে মাল্যভূষিত করেন এবং তাহাদের কতিপয় প্রতিনিধি মােহতারেমার ট্রাকের উপর আরােহণ করেন।
মহিলাদের সম্বর্ধনার পর মিস জিন্নাহ শেরেবাংলা ও সােহরওয়ার্দীর মাজার জেয়ারত করেন। বেলা একটায় মাজারের নিকটবর্তী গেষ্ট হাউসে প্রবেশ করার পর বেলা প্রায় চারিটা পর্যন্ত কয়েকহাজার লােক তাঁহাকে দেখিবার জন্য উক্ত হাউসের সম্মুখভাগে উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব