You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.10.13 | '৫৮ আর '৬৪ সালে অনেক তফাৎ- শাসকবর্গের প্রতি শেখ মুজিবের হুঁশিয়ারি | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
১৩ই অক্টোবর ১৯৬৪

‘৫৮ আর ‘৬৪ সালে অনেক তফাৎ
শাসকবর্গের প্রতি শেখ মুজিবের হুঁশিয়ারি

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (সােমবার) রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়ােজিত বাসাবাে এলাকায় অনুষ্ঠিত এক বিরাট কর্মী সম্মেলনে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেন, “আমি গণ-দুষমনদের জানাইয়া দিতে চাই যে, ১৯৫৮ সালের সঙ্গে ১৯৬৪ সালের অনেক তফাৎ। এইবার যদি গণ-দুষমনরা জরুরী পরিস্থিতির দোহাই দিয়া নির্বাচক মণ্ডলীর নির্বাচন বানচাল করিয়া দিতে চায় তবে দেশবাসী সর্ব শক্তি দিয়া তাহা রুখিয়া দাঁড়াইবে। ১৯৫৮ সালের মত বিনা প্রতিবাদে এবং বিনা সংগ্রামে দেশবাসী আর এক মুহুর্তের জন্যও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা মানিয়া লইবে না। গত দীর্ঘ দিনের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হইয়া দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাইয়াছে যে, গােলামীর চাইতে মৃত্যু ভাল”।
নির্বাচক মণ্ডলীর নির্বাচনের প্রাক্কালে নেতৃবৃন্দের নিকট হইতে নির্দেশ ও উপদেশ লাভের জন্য গতকল্য বাসাবাের যে বিরাট কর্মীবাহিনীর সমাবেশ দেখা যায় তাহা আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলের ইঙ্গিতবহ বলিয়া সংশ্লিষ্ট সকলেই মনে করেন। রাজারবাগ ইউনিয়নের সকল শ্রেণীর কর্মীরা একসঙ্গে সমবেত হন এবং আগামী নির্বাচনে সম্মিলিত বিরােধী দলকে জয়যুক্ত করার ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণ করেন।
কর্মীদের উদ্দেশ করিয়া শেখ মুজিব বলেন, ভাইসব, ত্যাগ ও সাধনা ছাড়া কোন মহৎ সগ্রামেই জয়যুক্ত হওয়া যায় না। আজ ত্যাগ ও সাধনারই সবচাইতে বেশী প্রয়ােজন। আজ আমাদের স্বাধীনতা বিপন্ন। আজ কে বড় কে ছােট সেই বিচারের সময় নাই। আপনারা সম্মিলিত বিরােধীদলের দিকে তাকাইয়া দেখুন, নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ প্রদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও আজ আমরা সবার সাম্য স্বীকার করিয়া লইয়াছি। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ছােট রাজনৈতিক দলের হাতে আমরা নেতৃত্বও ছাড়িয়া দিয়াছি। তিনি বলেন, ভাইরা আমার, স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তি নড়িয়া গিয়াছে। ভয় নাই, গণ-আন্দোলন অব্যাহত রাখুন, শীঘ্রই আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইবে।
কর্মীদের সাবধান করিয়া দিয়া শেখ মুজিব বলেন, কনভেনশন লীগের বহু দালাল আজ বন্ধুর ছদ্মবেশ ধারণ করিয়াছে এবং চোরাপথে সম্মিলিত বিরােধী দলের কোন কোন দলেও ইহারা অনুপ্রবেশ করিতেছে। এইসব ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ ব্যক্তিদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার হইতে হইবে। যেসব নির্যাতিত ও নিপীড়িত কর্মীর দাবী আপনাদের মনে ভাসিয়া উঠে, আজ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাহাদের স্মরণ রাখুন। যে সব কর্মী সংগ্রামের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন তাহাদের নির্বাচিত করুন।
তিনি বলেন, ভাইরা আমার, আজ যদিও আমি আওয়ামী লীগের প্রচার করিতে আসি নাই, তবু আপনাদের স্মরণ করাইয়া দেই যে, পূর্ব পাকিস্তানের উপর অবিচার করা চলিবে না, আন্তঃপ্রাদেশিক বৈষম্য দূর কর, বিনা বিচারে আটক রাখা চলিবে না, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই প্রভৃতি সকল শ্লোগানের জন্মদাতাই আওয়ামী লীগ। আজ সকল বিরােধীদলই এইসব শ্লোগান দেয়। পুলিসের লাঠির ঘা সহ্য করিয়া, কারাগারের নির্যাতন ভােগ করিয়া, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সর্বনাশ করিয়া আওয়ামী লীগ কর্মীরা যে গণদাবী আজ সার্বজনীন দাবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিয়াছে, তাহাই আওয়ামী লীগের সার্থকতা। কর্মী সম্মেলনের সভাপতি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ আজিজুর রহমান সভাপতির ভাষণদান প্রসঙ্গে কর্মীদের আহ্বান জানাইয়া বলেন যে, দেশবাসী ব্যালটের জোরে যে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছিলেন আজ সেই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য আবার দেশবাসীকে বুলেটের জবাব ব্যালেট দিয়া দিতে হইবে। মনে রাখিবেন, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মধ্যেই রহিয়াছে গণআন্দোলনের সার্থকতা। এইবার নির্বাচনকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করিতে হইবে এবং আপনারা যদি সত্যিকার স্বাধীনতা চান তবে আপনাদের প্রার্থীকে আপনারা অবশ্যই জয়যুক্ত করুন।
শাহ আজিজুর রহমান বলেন, আপনাদের অধিকার আপনাদের নিকট ফিরাইয়া দেওয়ার জন্যই মাদারে মিল্লাত এই বৃদ্ধ বয়সে সগ্রামের পথে নামিয়াছেন। তিনি জয়যুক্ত হইলে আমরা আমাদের হৃত স্বাধীনতা ফিরাইয়া পাইব। রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব আশরাফ উদ্দিন খােন্দকার নেতৃবৃন্দকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব তাজুদ্দিন আহমদও সভায় বক্তৃতা করেন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ও বর্তমানে কুমিল্লা সেন্ট্রাল জেলে আটক রাজবন্দী খােন্দকার মােসতাক আহমদ ও পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা খাজা রফিক সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী করিয়া সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। নির্বাচনী প্রচারে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের মত সকল সুযােগ-সুবিধা মিস জিন্নাহকে প্রদানের দাবী জানাইয়াও সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব