You dont have javascript enabled! Please enable it!

আজাদ
১৬ই অক্টোবর ১৯৬৪

পল্টনের জনসমুদ্রে আজম খানের বক্তৃতা

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য বৃহস্পতিবার সম্মিলিত বিরােধী দলের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের সাবেক জনপ্রিয় গবর্ণর লেঃ জেনারেল আজম খান বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়াইলে সভার বিশাল জনতা মুহুর্মুহুঃ করতালি দ্বারা তাঁহাকে অভিনন্দিত করে।
তিনি বলেন যে, আদালত জনসাধারণের সম্মুখে আজ ন্যায়বিচারের সুযােগ আনিয়া দিয়াছেন, তাহার পূর্ণ সুযােগ জনসাধারণকে গ্রহণ করিতে হইবে।
অতঃপর তিনি মিস জিন্নার নির্বাচনের কথা উল্লেখ করিয়া বলেন যে, এই বয়স্কা মহিয়সী মহিলা দেশের বর্তমান দুর্দিনে জাতিকে পথ প্রদর্শনের জন্য জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন। কায়েদে আজমের অনেক গুণের অধিকারিণী এই মহিয়সী নারী যদি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হইতে পারেন, তাহা হইলে দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হইবে।
তিনি আরও বলেন যে, জনসাধারণের সত্যিকার আজাদী ফিরাইয়া দেওয়ার জন্যই সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম শুরু করিয়াছেন।
জেনারেল আজম বলেন যে, দেশের ছেলেমেয়েদের এছলামের নীতিভিত্তিক প্রকৃত শিক্ষাদানের মাধ্যমে সত্যিকার নাগরিক হওয়ার শিক্ষা দেওয়া উচিত। কিন্তু একটি গণতন্ত্রহীন দেশে সেইরূপ কোন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা সম্ভবপর নহে।
তিনি পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের বীর ও সাহসী অধিবাসীদের প্রশংসা করিয়া বলেন যে, সর্বনাশা ঘুর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসেও তাঁহাদের দমাইতে পারে নাই। সুতরাং কোন একনায়কত্ব শাসনের পীড়ন তাহারা যে দীর্ঘদিন বরদাশত করিবেন না, তাহা নিশ্চিত।
মাহমুদুল হক ওসমানী
সারা পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহমুদুল হক ওসমানী বলেন, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছাহেব প্রায়ই ঘােষণা করেন যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এই জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টের আমলে যেমন, শ্রমিক, শিক্ষক কৃষক ও ছাত্র অসন্তোষ দেখা দিয়াছে তেমন আর কখনও দেখা যায় নাই। তাঁহার সামনেই দেশ সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক সঙ্কটের সম্মুখীন হইয়াছে। মওজুদ স্বর্ণের পরিমাণ বহুলাংশে হ্রাস পাইয়াছে।
জনাব ওসমানী আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব উপযুক্ত প্রার্থী পাইলে নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবেন না বলিয়া সাংবাদিক সম্মেলনে যে কথা ঘােষণা করিয়াছেন তাহা একটা কথার কথা। কারণ, সেই ‘উপযুক্ত প্রার্থী’ তাঁহার মনােমত হওয়া চাই। এবং এরূপ মনােমত প্রার্থী তিনি পাইবেন না। জনাব ওসমানী পাকিস্তান আন্দোলনে ঢাকার অবদানের কথা উল্লেখ করিয়া বলেন যে, ঢাকাবাসীরা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি অতঃপর পুনরায় শ্রমিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করিয়া বলেন এখন পূৰ্ব্ব পাকিস্তানে যেমন শ্রমিক নির্যাতন হইতেছে, বৃটিশ শাসনকালেও সেইরূপ ঘটে নাই। তদ্বারাই বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়।
মওলানা তর্কবাগিশ
সভাপতির ভাষণে মওলানা তর্কবাগিশ বলেন যে, মাদারে মিল্লাত বলিয়াছেন, তিনি অশ্রু চাহেন না। পূর্ব পাকিস্তানের ৫ কোটি মানুষের চোখের অশ্রু সরকারী অত্যাচারে নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। এখন রহিয়াছে কেবলমাত্র বহ্নি শিখা। মওলানা তর্কবাগিশ আরও বলেন যে, আজ নীতির প্রশ্নে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হইয়াছেন। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে মিস জিন্না যদি জয়যুক্ত হন তবে তাহা হইবে পাকিস্তানের ১০ কোটি মানুষের সত্যিকার জয়।
জনাব ফরিদ আহমদ
নেজামে এছলাম দলের সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় পরিষদের বিরােধী দলীয় অন্যতম সদস্য জনাব ফরিদ আহমদ বক্তৃতায় বলেন যে, স্বাধীনতা তথা জনসাধারণের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য আজ দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শুরু হইয়াছে, সর্ব প্রকার অন্যায় অত্যাচার ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠিয়াছে।
তিনি বলেন যে, মৌলিক অধিকার হারা দশ কোটি জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হইতেছেন মাদারে মিল্লাত। তিনি আজ সগ্রামী জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শরীক হইয়াছেন এবং আওয়াজ তুলিতেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। জনাব ফরিদ আহমদ পেশােয়ারে প্রদত্ত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বক্তৃতার উদ্ধৃতি উল্লেখ করিয়া বলেন যে, তিনি দেশের জন্য মঙ্গল করিতে চাহেন বলিয়া জানাইয়াছেন। কিন্তু সেই মঙ্গল বলিতে কি তিনি তাঁহার ব্যক্তিগত মঙ্গল অথবা পুজিপতি বা শিল্পপতিদের মঙ্গল বুঝান নাই?
বক্তৃতায় জনাব ফরিদ আহমদ আরও বলেন যে, কোনাে ব্যক্তি বিশেষের স্থায়িত্ব পাকিস্তানের স্থায়িত্ব নহে।
বর্তমান শাসনতন্ত্রের সমালােচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, কেবলমাত্র প্রেসিডেন্টের হাতে সকল ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করিয়া জনসাধারণের অধিকার খর্ব করা হইয়াছে, খাইবার হইতে চট্টল পৰ্য্যন্ত আওয়াজ উঠিয়াছে, এই শাসনতন্ত্র চাই না।
তিনি বলেন যে, বিরােধীদলে আজ যাহারা রহিয়াছেন, তাঁহারা পাকিস্তানের জন্য যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, জেল-জুলুম সহ্য করিয়াছেন কিন্তু ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা পাকিস্তানের জন্য কি করিয়াছেন ?
তিনি প্রশ্ন করেন, আমরা জানিতে চাই, আইয়ুব সরকার আমাদের জন্য কি করিয়াছেন? দেশবাসী আপনাদের চায় না তবুও কি আপনারা রাজত্ব করতে চান?
জনাব ফরিদ আহমদ আরও বলেন যে, দেশের শ্রমিক সমাজ আজ নির্যাতিত, শিক্ষকগণ বাঁচার অধিকার হইতে বঞ্চিত। জনসাধারণের সমর্থন ব্যতিরেকে আইয়ুব সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, সরকারী জুলুমের সমালােচনা করিয়া বক্তৃতা করায় পশ্চিম পাকিস্তানের গবর্ণরের নির্দেশে তাঁহাকে গ্রেফতার করা হয়।
শেখ মুজিবর রহমান
বক্তৃতায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে সংগ্রামের ঐতিহ্য রহিয়াছে। এই প্রদেশের ইতিহাস বিপ্লবের ইতিহাস এবং এখানে বহু সংগ্রামী যুবক জেল খাটিয়াছে, এমন কি আত্মাহুতিও দিয়াছে।
কাজেই আইনের বিরুদ্ধে যদি আইয়ুব সরকার ক্ষমতা দখল করিয়া থাকেন। তাহা হইলে সংগ্রামী জনসাধারণ তাহাদের ক্ষমতাচ্যুত করিতে বাধ্য করিবে বলিয়া তিনি ঘােষণা করেন।
তিনি প্রদেশবাসীর পক্ষ হইতে মাদারে মিল্লাতকে আশ্বাস প্রদান করেন যে, জনসাধারণের এই গণতান্ত্রিক সংগ্রাম অবশ্যই সাফল্য মণ্ডিত হইবে এবং সংগ্রামী জনসাধারণ আইয়ুব খান ও তাহার দালালদের দেশের বাহিরে হটাইয়া দিবেন।
অধ্যাপক গােলাম আজম
পূর্ব পাকিস্তান জামাতে এছলামী দলের সাধারণ সম্পাদক, অধ্যাপক গােলাম আজম বলেন যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যুদ্ধ করিয়া এই দেশ জয় করেন নাই, অতএব জনপ্রিয় না হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট পদে চিরস্থায়ী হওয়ার অধিকার তাঁহার নাই।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রহিয়াছে বলিয়া সরকারী দল যে প্রচার চালাইতেছে, তাহার তীব্র সমালােচনা করিয়া অধ্যাপক গােলাম আজম বলেন যে, যদি তাহাই হইয়া থাকে তবে জনসাধারণের ভােটে নির্বাচিত হওয়ার সাহস তিনি দেখাইতে পারিলেন না কেন?
অধ্যাপক গােলাম আজম বক্তৃতায় দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, গণদাবীর ভিত্তিতে এবং যে এছলামী গণতান্ত্রিক অধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তান অর্জিত হইয়াছে, প্রেসিডেন্ট সেই গণতন্ত্রের মর্যাদাহানি করিয়াছেন।
তিনি আরও বলেন যে, দেশের জনসাধারণ না খাইয়া মরিবে, শিক্ষকগণ ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত থাকিবেন এবং গুটিকতক লােক দিন দিন বিত্তশালী হইবেন- এইরূপ ব্যবস্থার জন্য পাকিস্তান হয় নাই।….
জনাব আবুল কাসেম
জাতীয় পরিষদের ডেপুটী স্পীকার এবং প্রাদেশিক মােছলেম লীগের সভাপতি জনাব আবুল কাসেম বক্তৃতায় বলেন যে, আজ দেশব্যাপী শাসনের নামে কেবলমাত্র নজীরবিহীন শােষণ চলিতেছে এবং সমগ্র দেশ কারাগারে পরিণত হইয়াছে। তিনি বলেন যে, বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় গরীব শ্রেণী ক্রমশঃই বিত্তহীন হইয়া অর্ধাহারে অনাহারে কাল কাটাইতেছে, পক্ষান্তরে বিত্তবানেরা ধনসম্পদে ক্রমেই ফুলিয়া ফাপিয়া উঠিতেছেন।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন যে বর্তমান সরকার ‘নিমক হারামী’ করিয়া জনসাধারণের অধিকার হরণ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই। বরং তাঁহাদের পিছনে জনসমর্থন রহিয়াছে বলিয়া সারা বিশ্বে অপপ্রচার করিতেছেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!