ইত্তেফাক
১৮ই অক্টোবর ১৯৬৪
বন্দরনগরী চট্টলের প্রাণ-বন্যায় গণতন্ত্রের জয় যাত্রা
মানব-সমুদ্রের ঘূর্ণিঝড়ে নিপীড়িত মানবতার রুদ্র-রােষ
সাড়ে তিন লক্ষাধিক লােকের সমাবেশে আইয়ুবের নিকট মিস জিন্নার কয়েক
দফা নয়া জিজ্ঞাসা
(ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি)
চট্টগ্রাম ১৭ই অক্টোবর- আজ অপরাহের লালদীঘি ময়দানের জনসভা প্রকৃতই যেন এক সীমাহীন জনসমুদ্র। মনে হয়, গােটা বঙ্গোপসাগরকেই লালদীঘি ময়দানে তুলিয়া আনা হইয়াছে, আর সেখানে ঝড়, ঝঞ্জা, তুফান তাদের পরিপূর্ণ প্রলয়ঙ্করী রূপ লইয়া আবির্ভূত হইয়াছে। ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছাস চট্টলবাসীদের চির পরিচিত হইলেও এমনটি তাহারা কখনও দেখে নাই।
ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছাস কিছু কালের জন্য মানব সভ্যতাকে ধূলিসাৎ করে, কিন্তু আজিকার এই মানব-সমুদ্রের জলােচ্ছাস জনগণের রাজনৈতিক দুশমনদের সামগ্রিক ভাবে পর্যুদস্ত করিয়া দিয়াছে। আজিকার জনসমুদ্রের বাণে গণ-দুশমনদের কেবল সুবর্ণ- সৌধই ভূমিসাৎ হয় নাই তিক্ততার গ্লানিতে তারা আজ ভীত সন্ত্রস্ত এবং চরম অসহায়ও বটে।
আজ সর্বত্র প্রতিটি চট্টলবাসী দুর্বার প্রাণের বেগ আর সঙ্কল্পে উদ্বেলিত উচ্ছ্বসিত। কবি ওয়ার্ডস ওয়ার্থের ভাষায় ঃ “ইষ্ট ওয়েকের হ্রদে অগণিত ড্যাফোডিল ফুল উফুল্লভাবে নাচছে আর ভাসছে।” এটাই হইতেছে বঙ্গোপসাগরের অগণিত উর্মিমালা- যাহার পরশে গণমনে সঞ্চারিত হইয়াছে এক দুর্বার জীবন বেগ।
চট্টলের এই জনসভা কেবল অভূতপূর্বই নয়, ভবিষ্যতে এমনটি হইবে বলিয়া কেহ ধারণা করতে পারে না। জনতার এই প্রাণের বেগ বঙ্গোপসাগর হইতে উখিত ঝড়াে হাওয়ায় গােটা প্রদেশেই বিপুল জাগরণ সৃষ্টি করিবে।
লালদীঘি ময়দানের অনুষ্ঠানে সাড়ে ৩ লক্ষ লােকের এই জনসভায় মিস জিন্নার উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল জনসমুদ্র উল্লাসে ফাটিয়া পড়ে। তাহারা ‘মাদারে মিল্লাত জিন্দাবাদ’, ‘গণতন্ত্র জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করিয়া তােলে। মিস ফাতেমা জিন্না বলেন, পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে পুনরায় বিরাট জাগরণ লক্ষ্য করিয়া তিনি মুগ্ধ ও অভিভূত হইয়াছেন। জনগণ তাহাদের সাধারণ লক্ষ্যের পিছনে ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে। তাহারা আর একবার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অনন্য সাধারণ ঐক্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। পাকিস্তানের জনগণ তাহাদের সম্মুখে উদ্ভূত পরিস্থিতি পুরাপুরি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। মিস জিন্না বলেন, জনগণের লক্ষ্য কি এবং তাহারা কি বিশ্বাস করে তৎসম্পর্কে দেশের প্রতিটি শিশুও যে ওয়াকিফহাল তাহা এই সম্বর্ধনা হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে। ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে মিস জিন্নার মহিলা সহচরী ও জাতীয় পরিষদ সদস্য বেগম রােকাইয়া আনােয়ার মিস জিন্নার ইংরেজী বক্তৃতার বাংলা তর্জমা পাঠ করিয়া শুনান। সভায় পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর লেঃ জেনারেল আজম খান, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান, নেজামে ইসলাম দলের মওলবী ফরিদ আহমদ, জামাতে ইসলামীর অধ্যাপক গােলাম আজম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা জনাব আবুল কাসেম, মীর আবদুল বাকী বেলুচ ও জনাব মহিউদ্দিন বক্তৃতা করেন। সভায় আজাদ কাশ্মীরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জনাব কে, এইচ, খুরশীদ এই সফরকালে প্রথম সংক্ষেপে জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন।
শেখ মুজিবর রহমান
শেখ মুজিব তাঁহার বক্তৃতায় বলেন যে, শুধুমাত্র জনগণের জন্য সংগ্রাম ও তাহাদের বন্ধন দশা হইতে মুক্ত করার জন্যই মিস জিন্না বৃদ্ধ বয়সে অবসর জীবন যাপন হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছেন। তিনি শ্রমিক, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী ও কৃষকদের উপর জুলুমের ষ্টিম রােলার চালানাের জন্য বর্তমান সরকারের সমালােচনা করেন। তিনি উপসংহারে বলেন যে, এখন আপনাদের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় আসিয়াছে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব