আজাদ
২১শে অক্টোবর ১৯৬৪
খাইবারগিরি হইতে চট্টলের সাগর সৈকত পর্যন্ত যে জন-জোয়ার আসিয়াছে
উহা মােকাবেলার জন্য প্রস্তুত হউন
ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রতি মাদারে মিল্লাতের চ্যালেঞ্জ
নাটোরের বিরাট জনসভায় নেতৃবৃন্দ কর্তৃক
আসন্ন নির্বাচনের গুরুত্ব বর্ণনা
নাটোর, ২০শে অক্টোবর।-গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য খাইবার হইতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গত এক মাসে যে অভূতপূর্ব উৎসাহ, উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে উহা মােকাবেলা করার জন্য মােহতারেমা মিস জিন্না অদ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের প্রতি এক চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন।
রাজশাহী হইতে মােটরযােগে এখানে আগমনের পর অদ্য সকালে স্থানীয় রেলষ্টেশনে আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে মােহতারেমা উপরােক্ত উক্তি করেন।
বর্তমান সরকারের প্রতি কোথাও কোন জনসমর্থন নাই, এই মর্মে মন্তব্য করিয়া মিস জিন্না বলেন যে, জনাব আইয়ুব খান তাঁহার ছয় বৎসরের শাসনকালে কখনই জনসাধারণের সম্বর্ধনা লাভ করেন নাই। এবং প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণের মােকাবেলা করিতে তিনি ভয় পান।
মিস জিন্না বলেন যে, আইয়ুব সরকার ক্ষমতা দখলের সময় এই প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে, দেশকে ঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত করিয়া তাহারা ব্যারাকে ফিরিয়া যাইবেন; কিন্তু আজ তাঁহারা পুনরায় আরও পাঁচ বৎসরের জন্য ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করিতেছেন। দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে সংগ্রাম পরিচালনার জন্য তিনি জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। এই সঙ্কটজনক মুহূর্তে সৎ এবং সত্যিকারের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার ব্যাপারে জনসাধারণের গুরুদায়িত্বের কথা তিনি স্মরণ করাইয়া দেন।
সম্মিলিত বিরােধী দলের নয়দফা কর্মসূচীতে জনসাধারণের গভীর আস্থা দেখিয়া তিনি বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করেন। মােহতারেমা বলেন যে, ১৯৪২ সালের উপ-নির্বাচনে কায়েদে আজমের মনােনীত প্রার্থীকে ভােট দিয়া জনসাধারণ যে ভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থনে রায় দিয়াছিলেন, এবারও তাহারা দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরও একবার মাথা। তুলিয়া দাঁড়াইবেন এবং মাদারে মিল্লাতের স্বপক্ষে ভােট দিবেন।
মিস জিন্না রাজশাহী হইতে এখানে আগমন করিলে হাজার হাজার নারীপুরুষ-শিশু তাঁহার মােটর গাড়ীর চারিপার্শ্বে জমায়েত হয়। এ সময় আওয়াজ ওঠে, নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবার, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, মাদারে মিল্লাত জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ। মােহতারেমা মিস জিন্নার বক্তৃতা শ্রবণের জন্য, তাঁহার দর্শন লাভের জন্য নাটোর রেল ষ্টেশন লােকে লােকারণ্য হইয়া যায়।
বহুলােক দালানের ছাদে এবং বৃক্ষে আরােহণ করিয়া মােহতারেমার দর্শন লাভের প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করে।
নাটোরের জনসভা শেষে মাদারে মিল্লাত একটি বিশেষ ট্রেনযােগে ঢাকা রওয়ানা হন। ষ্টেশনে সমবেত জনতা তাহাকে বিপুল বিদায় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে।
মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে নাটোর রেলষ্টেশনে অনুষ্ঠিত এই জনসভায় জেনারেল আজম খান, শেখ মুজিবর রহমান, জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব আখতারুদ্দীন আহমদ, জনাব আবদুল বাকী বালুচ, মওলবী ফরিদ আহমদ, জাতীয় পরিষদের ডেপুটী স্পীকার জনাব আবুল কাসেম প্রমুখ নেতা বক্তৃতা করেন।
জেনারেল আজম খান তাঁহার বক্তৃতায় বলেন যে, স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাইবার জন্য সর্বশক্তিমান খােদা মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনের মত একটি বিশেষ সুযােগ দিয়াছেন।
তিনি বলেন যে, কেবলমাত্র জনগণের সরকারই দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করিতে পারে।
জেনারেল আজম আরও বলেন যে, গণতন্ত্র আজ আপনাদের দুয়ারে আসিয়া দাড়াইয়াছে অতএব মাদারে মিল্লাতকে ভােট দিয়া চাবি সংগ্রহ করুন এবং দুয়ার উন্মুক্ত করুন। শেখ মুজিবর রহমান তাহার বক্তৃতায় দাবী করিয়া বলেন যে, পূৰ্ব্ব পাকিস্তানে মাদারে মিল্লাত অন্ততঃপক্ষে শতকরা সত্ত্বরটি ভােট লাভ করিবেন।
তিনি বলেন যে, যদি বর্তমান সরকারের নির্যাতনের যাতাকলে জনসাধারণ নিষ্পেষিত না হইয়া যদি তাহারা মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত না হইত তাহা হইলে বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দ মিস জিন্নাকে রাজনীতিতে টানিয়া আনিতেন না। জনাব আবদুল বাকী বালুচ বলেন যে, পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসে নাটোরের একটি বিশেষ স্থান রহিয়াছে। তাহার কারণ ১৯৪২ সালের প্রথম উপনির্বাচনে কায়েদে আজমের মনােনীত জনৈক মােছলেম লীগ প্রার্থী নাটোর হইতে নিৰ্বাচিত হইয়াছিলেন। তিনি বলেন যে, সেই ঐতিহাসিক নিৰ্বাচনের ২২বৎসর পর কায়েদে আজমের ভগ্নি যে মহান প্রয়ােজনে আপনাদের ভােট প্রার্থী হইয়াছেন উহা ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন অপেক্ষা কোন অংশে কম গুরুত্বের নহে। জনসভায় বক্তৃতাকালে। মওলবী ফরিদ আহমদ বলেন যে, মিস জিন্না গণতন্ত্র এবং জনগণের আজাদী হাছেলের সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, কায়েদের ভগ্নি যে কোন সরকারের অধীনে কোন উচ্চপদ গ্রহণের ইচ্ছা করিলে কেহই তাঁহাকে রােধ করিতে পারিত না। তিনি বলেন যে, এই সঙ্কটজনক মূহুর্তে মােহতারেমা মিস জিন্না জনসাধারণের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক স্বরূপ। জামাতে এছলামী নেতা জনাব আখতারুদ্দীন সরকারের দমন নীতির সমালােচনাকালে খুলনায় বেপরােয়া শ্রমিক হত্যার তীব্র নিন্দা করেন এবং এ সম্পর্কে আশু তদন্তের দাবী জানান।
সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী দেশের সমুদয় গণতান্ত্রিক শক্তিকে সংঘবদ্ধ হইতে আহ্বান জানাইয়া বলেন যে, দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা দেশ হইতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কুফল দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি উৎখাত করিতে হইবে। তিনি জনসাধারণকে কায়েদের আদর্শ একতা, ঈমান ও শৃংখলা অনুসরণ করার আহ্বান জানান। পি,পি,এ
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব