You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইত্তেফাক
৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৪

সেম-সাইড!

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
‘প্ররােচনার মুখেও জনগণের স্বাভাবিক
জীবনযাত্রা অক্ষুন্ন রাখার বজ্রকঠিন সঙ্কল্প’
শিরােনামায় পত্রিকা বিশেষের ফলাও সংবাদ এবং জনাব সরফুদ্দীন আহমদ প্রমুখের যুক্ত বিবৃতিতে দোকান-পাট খােলা রাখার আবেদন এবং গভর্নমেন্ট হাউসের গােপন বৈঠক- সব কিছু সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা নগরী সেই সরকারী
তরফকেও বিস্মিত করিয়া দিয়াছে। দোকান-পাট খােলা রাখার আবেদনের অন্যতম স্বাক্ষরকারী ইসলামিয়া লাইব্রেরীর মালিককেও এইদিন তাহার দোকানে ‘হরতাল পালন করিতে দেখা যায়। অর্থাৎ তাঁহার দোকান দুইটিও বন্ধই দেখা যায়।
এদিকে, ঢাকার বিশেষ একটি বাংলা দৈনিকের ফটোগ্রাফারের প্রতি খোলা দোকান-পাটের ছবি তুলিয়া আনার নির্দেশ থাকায়, তিনি কোথাও কোন দোকান খােলা না পাইয়া রায়সাহেব বাজারের সম্মুখস্থ কোন একটি হােটেল খােলা থাকিতে দেখিয়া উহার ছবি তুলেন। হােটেল মালিক উক্ত ফটোগ্রাফারকে বিরােধী দলের সমর্থক কোন পত্রিকার প্রতিনিধি এবং অসৎ উদ্দেশ্যেই তিনি ছবি তুলিতেছেন মনে করিয়া পাকড়াও করেন এবং ক্যামেরাটি ছিনাইয়া লন। হােটেলের বয়-বেয়ারারা ফটোগ্রাফারটিকে বেশ নাজেহাল করে। পরে অপর কতিপয় ব্যক্তির মধ্যস্থতায় হােটেল মালিক তাঁহার ত্রুটি বুঝিতে পারিয়া ক্যামেরাম্যানটির দাবী মতে (তিনি নিজেকে দৈনিক সংবাদের ফটোগ্রাফার বলিয়া দাবী করিয়াছিলেন) দৈনিক সংবাদ অফিসে গিয়া ক্যামেরাটি ফেরত দেন এবং ক্ষমা ভিক্ষা করেন। কিন্তু সংবাদ কর্তৃপক্ষ উক্ত ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যান তাঁহাদের নহে বলিয়া জানাইলে এক পরম বিস্ময়ের কারণ ঘটে। অর্থাৎ দেখা যায়, উক্ত ক্যামেরাম্যানটি সরকার দলীয় একটি পত্রিকারই প্রতিনিধি। ব্যাপারটির এবম্বিধ পরিণতি দৃষ্টে হােটেল মালিক বড়ই লজ্জা পান। সুতরাং নির্বাচনের ব্যাপারে মারামারির অবকাশ কোথায়?
শেখ মুজিবর রহমান
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান। তুমুল করতালি ও জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে মাইক্রোফোনের দিকে আগাইয়া যান। বিপুলায়তন জনসভার চতুর্দিকে অবলােকন করিয়া তিনি বলেন, দেশবাসী ভাই ও বােনেরা আমার! জালেম যখন জুলুম করে, অত্যাচারী যখন অত্যাচার করে তখন স্বভাবতঃ সাধারণ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ জালেম ও অত্যাচারীতর বিরুদ্ধাচরণের সাহস পায় না। কিন্তু জুলুম আর অত্যাচার যখন সীমা ছাড়াইয়া দুর্বিষহ ও অসহনীয় হইয়া উঠে, তখন মানুষ মরিয়া হইয়া উঠে। নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষ যদি একবার প্রতিঘাত শুরু করে তবে জালেম আর অত্যাচারীর সম্পূর্ণ সর্বনাশ সাধন করিয়া তবে নিরস্ত হয়। নির্যাতিত মানুষের প্রতিঘাত আজ শুরু হইয়াছে এবং অদ্যকার জুলুম প্রতিরােধ দিবসের সার্থকতা, পল্টনের এই অবিস্মরণীয় জনসভা প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে প্রতিঘাতের দুর্জয় স্বাক্ষর এই কথাই ঘােষণা করিতেছে যে, জালেমের শেষদিন ঘনাইয়া আসিয়াছে।
উৎফুল্ল জনতার তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান সরকারী কর্তাদের প্রতি আহ্বান জানাইয়া বলেন, আপনাদের চোখ আছে কিনা জানি না, কান আছে কিনা জানি না, যদি আপনাদের চক্ষু থাকিয়া থাকে তবে দেখুন এই পল্টনে আজ বিক্ষুব্ধ মানুষের মহাসমুদ্র। যদি আপনাদের কান থাকিয়া থাকে তবে শুনুন বিক্ষুব্ধ মানুষের ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ ‘জুলুমবাদী চলবে না। আপনারা দেখিয়া ও শুনিয়া উপলব্ধি করুন যে, নির্যাতিত মানুষ আপনাদের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হইয়া আজ কতদূর আগাইয়া গিয়াছে এবং অদূরভবিষ্যতে জনতার এই অগ্রগতি কি রূপ পরিগ্রহ করিবে।
শেখ মুজিবর রহমান সরকারকে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়া বলেন যে, কিষাণ, মজুর, মধ্যবিত্ত আজ সংগ্রামের প্রতিশ্রুতিতে ঐক্যবদ্ধ। আজও যদি সরকার মানুষের জন্মগত অধিকার ফিরাইয়া দেওয়ার ব্যাপারে টালবাহানা করেন তবে দেশব্যাপী যে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হইবে উহার তীব্রতার ‘ছােট খান, ‘বড় খান, সকল খানের শাদ্দাদী বেহেস্ত ভাঙ্গিয়া চুরমার হইয়া যাইবে। ভাইরা আমার! নির্যাতনের ইতিহাস বর্ণনা করিয়া শেষ করা যাইবে না। সরকার মালিকের পক্ষ সমর্থন করিয়া শ্রমিকদের ধর্মঘট বেআইনী ঘােষণা করিয়াছে।
সরকার এই দেশের শিক্ষকদের নানাভাবে শায়েস্তা করিতে দ্বিধা করে নাই। এই দেশের সরকার মাগুরায় গুলী করিয়া তিন তিনজন কৃষককে হত্যা করিয়াছে। এই দেশের সরকার বেলুচিস্তানের ঈদের জামাতে বােমা বর্ষণ করিয়া নিরীহ গ্রামবাসীর প্রাণনাশ করিয়াছে, এই দেশেরই সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে করাচীতে দুইমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করিয়া রাখিয়াছে।
ভাইরা আমার ! ছােট খান বড় খানের দলেরা অদ্যকার জুলুম প্রতিরােধ দিবসকে বানচাল করার জন্য গুণ্ডা নিযুক্ত করিয়াছিল। কোথায় সেই গুণ্ডারা? সংগ্রামশীল মানুষ মরণকে ভয় করে না, গুণ্ডাকে তাদের ভয় কি? আজ আমি সরকারকে পরিষ্কার করিয়া জানাইয়া দিতে চাই, আজ দেশময় চাকা বন্ধ হইয়াছে, এখনও সময় আছে, দেশবাসীর দাবী মানিয়া লও। অধিক বিলম্বে এই দেশের মানুষ করদান বন্ধ করিবে, তােমাদের তখত-তাউসও নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে। আমরা বিশৃংখলা সৃষ্টি করিতে চাই না। কিন্তু যদি বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়, তবে তার জন্য পিণ্ডি ও ঢাকার বাহাদুরেরাই দায়ী থাকিবেন।
বক্তৃতার উপসংহারে শেখ মুজিবর রহমান বলেন, ভাইরা, যাইবার বেলায় ডাক দিয়া যাই ঐক্যবন্ধ হও। ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হউন। দুনিয়া হইতে যুগে যুগে সব জালেমই নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে; আমাদের দেশের জালেমরাও নিপাত যাইবে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!