ইত্তেফাক
৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৪
মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন দেশবাসীর প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরূপ
– শেখ মুজিব
(ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি প্রেরিত)
মৌলবীবাজার (সিলেট), ৩রা সেপ্টেম্বর- “আসন্ন মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন শুধু নির্বাচন নয়, দেশবাসীর প্রতি উহা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হইয়া দেখা দিয়াছে। দেশের বুকে সামরিক শাসন চাপাইয়া রাখিয়া শাসনতন্ত্র কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষা করিয়া দেশবাসীর উপর যে এক ব্যক্তি রচিত শাসনতন্ত্র চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে, শত অনুরােধ-উপরােধ সত্ত্বেও সে সম্পর্কে জনমত যাচাই-এর প্রস্তাবে সরকার সম্মত হন নাই। আগামী নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়াই কেবল দেশবাসী এই শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁহাদের সুস্পষ্ট মতামত জানাইয়া দিতে পারে। কারণ, এই নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়াই প্রমাণিত হইবে, দেশবাসীরাই দেশের সত্যিকারের মালিক, না কায়েমী স্বার্থবাদীরাই সকল শাসন-ক্ষমতা কুক্ষিগত করিয়া রাখার অধিকারী। খােদা-না-খাস্তা যদি এই নির্বাচনে জনসাধারণ পরাজিত হয় তবে দেশে স্থায়ীভাবে একনায়কতন্ত্র কায়েম হইবে এবং সাধারণ মানুষ ক্রীতদাসে পর্যবসিত হইবে। আমি আপনাদের বলি, আর সময় নাই, আপনারা জাগুন। আপনারা কি দেখেন না যে, আপনাদেরই চোখের সামনে আপনাদেরকে ভেড়া ছাগলের মত বিক্রয় করিয়া দিয়া এক শ্রেণীর লােক দেশে ডাণ্ডা ঘুরাইতেছে আর আপনারা তাহা বরদাশত করিতেছেন। আপনারা এমন গণআন্দোলন গড়িয়া তুলুন যাহাতে এই দুশমনেরা শিহরিয়া উঠে এবং অদ্য স্থানীয় ক্লাব প্রাঙ্গণে আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান উপরােক্ত ঘােষণা করেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করিয়া সহস্র সহস্র লােকের বিরাট জনতা বক্তাদের বক্তৃতা শ্রবণ করেন।
শেখ মুজিব বলেন যে, যেহেতু দেশবাসী আজ সত্যই বুঝেন, কি নিদারুণ তাঁহাদের অবস্থা; সুতরাং তাহাদের আজ ইহাও বুঝিতে হইবে, কি তাহাদের কর্তব্য।
শেখ মুজিব বলেনঃ কায়েমী স্বার্থবাদীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হইতে জনসাধারণকে যে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করিয়াছে এবং আন্তর্জাতিক দুনিয়ার মুখরক্ষার জন্য দেশে মৌলিক গণতন্ত্র নামে যে তথাকথিত গণতন্ত্র চালু করিয়াছে সে কথা আজ সর্বজনবিদিত। তথাকথিত বিপ্লবােত্তর যুগে দেশের বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ শুধু যে রাজনৈতিক দিক দিয়াই কায়েমী স্বার্থবাদের স্বীকারে পর্যবসিত হইয়াছে তাহাই নয়, অর্থনৈতিক দিক দিয়া আজ পূর্ব পাকিস্তানীরা সর্বস্ব খােয়াইতে বসিয়াছে। সমসাময়িক কালের পুঁজিবিনিয়ােগের ইতিহাস পর্যালােচনা করিলে দেখা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা বিপ্লবের বদৌলতে পূর্ব পাকিস্তানে সকল প্রকার আভ্যন্তরীণ ও বর্হিবাণিজ্য, ক্ষুদ্র ও বৃহদায়তন শিল্প প্রভৃতি সকল ক্ষেত্র হইতে ক্রমে ক্রমে অপসারিত হইতেছে। গ্রামীণ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামাে সম্পূর্ণ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। ট্যাক্সের চাপে, দৈনন্দিন প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্যে, কৃষিজাত দ্রব্যাদির নিম্নমূল্যে আজ কৃষকের জীবন। দুর্বিষহ হইয়া উঠিয়াছে। এই নিদারুণ পরিস্থিতিতে ওয়ার্কস প্রােগ্রামের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থের হরিলুট চলিয়াছে আর দলীয় স্বার্থে সরকারী অর্থকোষ হইতে অকাতরে অর্থ অপচয় করা হইতেছে। দেশবাসী আজ অসহায়ের মত এই ব্যাভিচার অবলােকন করিতেছে। কিন্তু আর সময় নাই, আজ দুর্জয় ও দুর্বার গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়া এই কায়েমী স্বার্থবাদীদের নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে হইবে। কায়েমী স্বার্থবাদীরা যে দৃঢ়তার সহিত আজ শাসনব্যবস্থায় শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছে তাহাকে উৎখাত করিতে হইলে ছিটাফোটা আন্দোলন যথেষ্ট নয়, ‘গণদুশমনদের’ পর্যুদস্ত করার জন্য আজ সকল পর্যায়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইবে।
তিনি বলেন, দেশের পাঁচটি বিরােধী দল দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে নিজেদের ‘পথ ও মত ত্যাগ করিয়া ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে। দেশবাসীও আজ ঐক্যবদ্ধ হইয়া দুর্বার আন্দোলন গড়িয়া তুলুন। আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জনসাধারণের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও মনােবল লক্ষ্য করিয়াছি, তাহাতে আমার স্থির বিশ্বাস যে, জনতার জয় সুনিশ্চিত।
জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য জনাব আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়া দেন যে, তথাকথিত বিপ্লবের পর পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হইয়া উঠিয়াছে। যে ভােটাধিকারের জোরে দেশবাসী পাকিস্তান অর্জন করিয়াছিল আজ কুচক্রীরা সেই দেশবাসীকে ‘গরু ছাগলের’ পর্যায়ে নামাইয়া দিয়াছেন। আজ তাহাদের ভােটাধিকারই শুধু ছিনাইয়া নেওয়া হয় নাই, তাহাদের উপর অসহ্য করভার চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
জনাব চৌধুরী বলেন যে, সভ্য জগতের সকল আইনকানুন উপেক্ষা করিয়া শাসকবর্গ নিজেদের তৈরী একটি শাসনতন্ত্র দেশবাসীর উপর চাপাইয়া দিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, এই শাসনতন্ত্রের মধ্য দিয়া দেশে একনায়কত্ব কায়েমের ব্যবস্থাও করা হইয়াছে। জনাব চৌধুরী হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য দেশবাসীকে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানান।
জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী অর্থনৈতিক দিক দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের উপর যে অবিচার করা হইতেছে। তাহার বিস্তারিত আলােচনা করেন। সাবেক ছাত্রনেতা শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন বর্তমান সরকারের নির্যাতন নীতির তীব্র নিন্দা করেন। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব আবদুল হাই এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব তাজুদ্দিন আহমদ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাহার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি সভায় বক্তৃতা করিতে পারেন নাই।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব