You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইত্তেফাক
১৬ই আগস্ট ১৯৬৪

ক্রুগ মিশনের সুপারিশ মােতাবেক প্রদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ দাবী
১৪ই আগষ্ট উপলক্ষে প্রদত্ত শেখ মুজিবের বিবৃতির অবশিষ্ট বিবরণ

পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান এক বিবৃতিতে বলেনঃ বন্যা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করিয়া সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা বন্যার কবল হইতে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য স্থায়ীভাবে বন্যা নিরােধ পরিকল্পনা প্রণয়ন কল্পে ক্রুগ মিশন নিয়ােগ করেন। বিশদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ক্রুগ মিশন এই অভিমত জ্ঞাপন করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা রােধ করা শুধু সম্ভবই নহে বরং বন্যা নিরােধ পরিকল্পনা দ্বারা কৃষি ভূমির সেচ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাইতে পারে। উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১০০০ কোটি টাকার প্রয়ােজন বলিয়া উল্লেখ করা হয়। ক্রুগ মিশনের সুপারিশ কার্যকরী করার মুখ্য উদ্দেশ্যই ওয়াপদা প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এখন দেখা যায় যে, বন্যা নিরােধকল্পে কোন কিছুই করা হয় নাই। জনগণের চরম দুর্গতি। আওয়ামী লীগ সম্পাদক আরও বলেন : করভাবে জর্জরিত জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় বৃদ্ধি, অলাভজনক পাটের মূল্য এবং ক্রমবর্ধমান বেকারের অভিশাপে প্রদেশের মানুষ যখন জর্জরিত, তখন বন্যা আসিয়া জনসাধারণকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করিয়া দিয়াছে। বন্যার ফলে শস্যাদি ও গবাদিপশুর মৃত্যু, আশ্রয়ের অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন-যাপন ও খাদ্যাভাব মানুষকে দিশাহারা করিয়া ফেলিয়াছে। সরকারের তরফ হইতে বলা হইয়াছে যে, বন্যায় ৪৩ লক্ষ লােক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে, কিন্তু আসলে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা আরও অনেক বেশী। সরকারী হিসাব ঠিক ধরিয়া নিলেও দেখা যায় যে, সরকার যে পরিমাণ সাহায্যদান করিয়াছে, উহা মাথাপিছু তিন আনার বেশী নহে।
মরার উপর খাড়ার ঘা
সরকার আশ্বাস দান করিয়াছেন যে, আগামী ৬ মাসে দেশে খাদ্যাভাব হইবে না, অথচ সরকার রেশনের চাউলের মূল্য মণপ্রতি ২ টাকা ২৫ পয়সা বৃদ্ধি করিয়া প্রতিমণ চাউলের মূল্য ২৬ টাকায় উন্নীত করিয়াছেন। জনগণের এই সীমাহীন দুর্দশার সময়ে সরকারের গুদামজাত চাউলের মূল্য বৃদ্ধি করার কারণ বুঝিয়া উঠা মুশকিল। ভাগ্যের পরিহাস যে, একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে সরকার বন্যা উপদ্রুত লােকদের বিনামূল্যে খাদ্য ও সাহায্য দান করিতেছেন।
কর্তাব্যক্তি বনাম বিশেষজ্ঞ
শেখ মুজিব বলেন ঃ কিছুদিন পূর্বে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে গভর্নর বলিয়াছিলেন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যার কোন স্থায়ী সমাধান সম্ভব নহে। অথচ মাত্র ৮ বৎসর পূর্বে ক্রুগমিশন অভিমত জ্ঞাপন করিয়াছিলেন যে, বন্যা রােধ করা সম্ভব এবং বন্যা রােধের ফলে জনসাধারণ শুধু বন্যার ধ্বংসলীলা হইতেই মুক্তিলাভ করিবে না, উহা দ্বারা তাহাদের অন্যবিধ কল্যাণ সাধিত হইবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান শাসকরা ক্রুগ মিশনের সেই পরিকল্পনাকে শিকায় তুলিয়া রাখিয়াছেন। গভর্নরের মন্তব্য হইতে ইহা পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে যে, সরকার সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হইয়াছেন এবং বন্যার সকল দায়িত্ব প্রকৃতির উপর চাপাইয়া দিয়া জনসাধারণের দৃষ্টি অন্য দিকে নিবদ্ধ করার সুচতুর প্রচেষ্টায় মাতিয়াছেন। ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নিজের সরকারের ব্যর্থতা অদক্ষতার কথা প্রকাশ করার পূর্বে গভর্নরের ন্যায় দায়িত্বশীল পদ হইতে তাহার পদত্যাগ করা উচিত ছিল। গভর্নর বন্যার ন্যায় প্রাকৃতিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান অসম্ভব বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। অথচ এ-ব্যাপারে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের অভিমত সংগ্রহের জন্য দৈনিক ৪,৫০০ টাকা ব্যয় করা হইতেছে।
ক্রুগ মিশনের সুপারিশ কার্যকরী করা হয় না
শেখ মুজিবর এক প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া বলেনঃ ক্রুগ মিশনের সুপারিশ কোথায় এবং সেই সুপারিশ মােতাবেক কাজ করা হইতেছে না কেন? আর ওয়াপদাই বা কেন এখন মহাপরিকল্পনার কথা বলিতেছে। জনসাধারণকে তাহাদের ভাগ্যে কি আছে তাহা জানান হইবে কি?
জীবন-মরণ সমস্যা
শেখ মুজিবর রহমান আরও বলেনঃ পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ বন্যাকে জীবনমরণ সমস্যা বলিয়া মনে করে এবং এই সমস্যাকে মানবিক সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করিয়া উহার সমাধানে সরকার তৎপর হইবেন বলিয়া তাহারা আশা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধু অববাহিকা পরিকল্পনা ও ভূমির লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হইতেছে বলিয়া পূর্ব পাকিস্তানীরা ইর্ষান্বিত নহে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থ না দিয়া ইসলামাবাদে রাজধানী নির্মাণে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় এবং অনুৎপাদনশীল তথাকথিত ওয়ার্কস প্রােগ্রামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করিতে দেখিলে তাহারা বিক্ষুব্ধ না হইয়া পারে না।
বন্যা নিয়ন্ত্রণে সর্বশক্তি নিয়ােগের দাবী
শেখ মুজিবর বলেন ও বন্যার ভয়াবহতা রােধকল্পে দেশের সর্বশক্তি নিয়ােগ করা প্রয়ােজন। তা ছাড়া বর্তমানে বন্যার্তদের আশ্রয়, খাদ্য, ঔষধ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সহ সর্বপ্রকার সাহায্য লইয়া সরকারের আগাইয়া আসা প্রয়ােজন। বর্তমানে যে ছিটেফোটা সাহায্য দান করা হইতেছে তাহাও ক্ষমতাসীন দলের লােকদের দ্বারা পরিচালিত হইতেছে। আমরা এখনও আশা করি, সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করিয়া মানবতার প্রশ্নে সাহায্য দান ব্যবস্থাকে রাজনীতির উর্ধ্বে স্থান দান করিবেন। তিনি বলেনঃ আওয়ামী লীগ বন্যার্তদের সাহায্য দানের ব্যাপারে সর্বপ্রকার সহযােগিতা দানে প্রস্তুত। শেখ মুজিবর আওয়ামী লীগ কর্মীদের উদ্দেশে বলেনঃ বন্যার্ত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মােচনের ব্যাপারে আপনারা সর্বশক্তি নিয়ােগ করুন।
পরিশেষে শেখ মুজিব বলেনঃ ইসলামাবাদে রাজধানী নির্মাণসহ বিভিন্ন স্থানে এলােপাথারিভাবে যে জাতীয় সম্পদ ব্যয় করা হইতেছে, উহা অবিলম্বে বন্ধ করিয়া উক্ত অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রণীত ক্রুগ মিশনের সুপারিশ কার্যকরী করার দাবী জানাইতেছি। ইহাও জানাইয়া দিতে চাই যে, বর্তমান সরকারকে পরিষ্কার ভাষায় সতর্ক করিয়া দিয়া বলিতে চাই যে, মানুষের জীবন লইয়া ছিনিমিনি খেলার কোন অধিকার সরকারের নাই।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!