ইত্তেফাক
১৮ই আগস্ট ১৯৬৪
ওয়াহিদুজ্জামানের অপপ্রচারের জবাবে
শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান গতকল্য এক বিবৃতিতে বলেন, স্থানীয় সংবাদপত্রসমূহে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী জনাব ওয়াহিদুজ্জামানের বক্তৃতা বলিয়া কথিত একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে করাচীতে তিনি উক্ত বক্তৃতা প্রদান করেন। ছাত্র সমাজ, আওয়ামী লীগ এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উদগীরণের জন্য তিনি আজাদীর পবিত্র দিনটি পছন্দ করিয়াছেন। এই ধরনের এলােপাথাড়ি প্রলাপের কারণ পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণের নিকট অতীব স্পষ্ট এবং উহা ব্যাখ্যার কোন ভূমিকার প্রয়ােজন করে না। ছাত্রদের সম্পর্কে তাহার বক্রোক্তির উপযুক্ত জবাব নিঃসন্দেহে ছাত্ররাই প্রদান করিবে। আমি জনাব জামানকে শুধু ইহাই স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, ন্যায়-অন্যায় পরখ করার জন্য ছাত্ররা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তােষামােদ বা ধমক তাহাদের ন্যায়ের পথ হইতে বিরত রাখিতে পারিবে না। গরীব পিতামাতার কষ্টার্জিত অর্থ তাহাদের এই পথ চিনাইয়া দিয়াছে যাহারা কি না মােসাহেবদের দ্বারা প্রতি পদে প্রবঞ্চিত হইয়াছে। প্রভুদের সন্তুষ্টি বিধানই ইহাদের প্রবঞ্চনা ও বিশ্বাসঘাতকতার উদ্দেশ্য।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক নাটকে জনাব জামান এবং তাহার সহঅভিনেতাদের নিকট আওয়ামী লীগ সহজবােধ্য কারণে চক্ষুশূলরূপে বিরাজমান। ভ্রকুটি-বাণ এবং কারা নির্যাতনসহ সকল প্রকার উৎপীড়ন, নিপীড়ন ও দমননীতির মুখে আওয়ামী লীগ এই দেশে নিয়মতান্ত্রিক বিরােধীপক্ষ গড়িয়া তুলিয়াছে। ইহারই পরিণতিতে ১৯৫৪ সালে জনাব জামান এবং তাঁহার তদানীন্তন মনিবদের মুসলিম লীগের নিরাপদ তরণীসহ জনমতের অসীম সমুদ্রের অগাধ গভীরে ভরাডুবি হইয়াছিল। ইহার জ্বালা তিনি এত শীঘ্র বিস্মৃত হইবেন কি করিয়া।
তবে একটি বিষয় তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন দেখা যায়। তাহা হইল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাঁহার পরাজয়। অন্যথায় তিনি পূর্ববর্তী নির্বাচনসমূহে জয়লাভ করিয়া ছিলেন বলিয়া দাবী করিতেন না। তিনি আমার নিকট স্রেফ দশ হাজার ভােটের ব্যবধানে পরাজয় বরণ করিয়াছিলেন এই তথ্য গােপন করিয়া আত্মপ্রবঞ্চনার আশ্রয় না লইলে আমি আনন্দের সঙ্গেই চুপ থাকিতাম। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের নিরাপদ ছত্রচ্ছায়ায় অনুষ্ঠিত সীমিত ভােটের নির্বাচনী মহড়াতেই শুধু তিনি জয়লাভ করিয়াছিলেন। তাও আমি এবং আরও শত শত ব্যক্তিকে তখন কারা প্রাচীরের অন্তরালে রাখা হইয়াছিল। এমনকি তখনও তিনি আইয়ুব শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলিয়া সীমাবদ্ধ ভােটারদের প্রতারণা করিয়াছিলেন। উপনির্বাচন সম্পর্কে বলিতে হয় যে, গােটা দেশই ইহার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত। নির্বাচন সম্পর্কে তিনি এতই আশাবাদী হইয়া থাকিলে তাহার উচিত জনসাধারণকে ভােটাধিকার এবং আসন্ন নির্বাচনে সকলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযােগ দানের জন্য তাঁহার নেতাকে রাজী করানাে। জনসাধারণ ভােটাধিকার বঞ্চিত এবং তাঁহার নেতা আমাকে সহ আরও বহুজনকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযােগ্য ঘােষণা করিয়াছেন দেখিয়া তিনি শূন্য ময়দানে আস্তিন গুটাইতেছেন। তাঁহার নেতৃবৃন্দ এবং দল জনসমর্থন সম্পর্কে এতই নিশ্চিত হইয়া থাকিলে তাহারা প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন এবং অযােগ্য ঘােষিত রাজনীতিকদের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করুন। সেক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত যে, তাহার পূর্ববর্তী মনিবদের মতই তাহাদের একই রূপ ভাগ্য বরণ করিতে হইবে। ফলে তাঁহাকে নূতনভাবে নূতন মনিব গােষ্ঠী খুঁজিয়া লইতে হইবে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব