You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইত্তেফাক
২০শে জুলাই ১৯৬৪

প্রমাণ করুন, নির্যাতন-নিষ্পেষণের নিকট নতি স্বীকার করেন নাই
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবের আহ্বান

(ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি প্রেরিত)
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৯শে জুলাই- দেশবাসীর পবিত্র আমানতের খেয়ানত করিয়া, রাতের অন্ধকারে দশকোটি নিরীহ দেশবাসীকে সুপ্তি মগ্ন রাখিয়া দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়া, শুধুমাত্র গােষ্ঠী স্বার্থ রক্ষার জন্য যে অশুভ চক্র রাজনৈতিক ক্ষমতা বলপূর্বক কুক্ষিগত করিয়াছে এবং যে অশুভ চক্র দেশবাসীর মৌলিক অধিকার হরণ করিয়াছে, ভােটাধিকার হরণ করিয়াছে, দেশে শ্ৰেণীবিভেদ সৃষ্টি করিয়াছে- সেই চক্রের সহিত কোনরূপ আপােষ নাই। আজ সর্বশক্তি লইয়া ইউনিয়নে ইউনিয়নে, গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে এই অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে অজেয় ন্যূহ রচনা করিতে হইবে এবং আসন্ন মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে সত্যকারের জনসাধারণের দাবী-দাওয়ার ধারক ও বাহককে ভােট দিয়া জয়যুক্ত করিয়া অশুভ চক্রটিকে দেখাইয়া দিতে হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তান নির্যাতন, নিষ্পেষণ ও নিপীড়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে নাই। বরঞ্চ দ্বিগুণ শক্তি সঞ্চয় করিয়া শত্রুর দুর্ভেদ্য দুর্গ ভুলুণ্ঠিত করিয়া দিয়াছে।”
অদ্য স্থানীয় রিপাবলিক স্কোয়ারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান দৃপ্তকণ্ঠে উপরােক্ত ঘােষণা করেন।
সামরিক শাসনােত্তর যুগের শাসন ব্যবস্থার কঠোর সমালােচনা করিয়া শেখ মুজিব ঘােষণা করেন যে, আজ আমরা যখন আপনাদের সম্মুখে বক্তৃতা করি তখন আমরা নিঃস্বার্থভাবেই বক্তৃতা করি। কারণ আজ আমরা দেশের কাছে ও দশের কাছে অপাংক্তেয় হইয়া গিয়াছি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চোঙ্গা ফুকিয়া নিজের জীবন যৌবন ব্যর্থ করিয়া দিয়া অভিভাবকদের সার্বিক জীবন বিষাক্ত করিয়া তুলিয়া, বৃদ্ধা মাতার কোটরাগত চক্ষুতে অশ্রুর বান বহাইয়া দিয়া এবং পরবর্তী পর্যায়ে দেশের জনসাধারণের রাজ্য কায়েম করার সংগ্রামে নিজের পরিবার-পরিজনকে দুঃখ-দুর্দশার মুখে ঠেলিয়া দিয়া কারাগারের ক্লান্তিকর পরিবেশে ক্ষয়রােগীর মত নিজের জীবনের মুহূর্তগুলিকে ক্ষয় করিয়া দিয়া আজ আজব আইনে আমরা এবডাে আর প্রডাে কবলিত। ভাইসব, দেশের কাজ করিয়া আজ আমরা নির্বাচনে অযােগ্য ঘােষিত হইয়াছি। তাই আজ আমরা যখন বক্তৃতা করি তখন আমরা আপনাদের কাছে ভােট চাই না।
ভাইসব, আজ দেশের আইন পাল্টাইয়া গিয়াছে। আজ দেশের কাজে যাহারা কারাবরণ করিয়াছেন (৯ মাসের বেশী) তাঁহারা নির্বাচনের অযােগ্য ; আর যাঁহারা ইংরেজ প্রভুদের চাকরী করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের বুকে সঙ্গীন উঁচাইয়া ধরিত আর হুকুম পাইলে গুলী করিতে যাহাদের এক মুহূর্তও বিলম্ব হইত না তাঁহারাই আজ প্রেসিডেন্ট হইবার যােগ্যতাও রাখে। ভাইসব, আজ আপনারাই ভাবুন, ১৯৫৮ সালে আপনারা যে পণ্য যে মূল্যে বিক্রয় করিতেন আজ তাহার মূল্য কত কমিয়াছে ? আজ আপনারাই বলুন, ১৯৫৮ সালে আপনারা যে দ্রব্য যে মূল্যে ক্রয় করিতেন তাহার মূল্য কত বৃদ্ধি পাইয়াছে ? আপনারা দেশের জনসাধারণ, এই যােগ-বিয়ােগের অঙ্কটুকু কষিয়া দেখুন এবং ভাবুন, আজ আপনারা আছেন কোথায়? আমি তাে ভাবিয়াই পাই না যে, আপনারা করিবেন কি ? আমরাই বা আপনাদের কি করিতে বলিব ?
শেখ মুজিব দরদভরা কণ্ঠে জনতাকে জিজ্ঞাসা করেন, ভাইসব আপনারা কি আজ কিছুই বুঝেন না ? আপনারা কি আজ এ-ও বুঝেন না যে, সরকার আজ পাটের মণ প্রতি ১০ টাকা মূল্য দিয়াও বক্তৃতা করিয়া বলেন যে, পাটের আন্তর্জাতিক বাজার মন্দা হইয়া পড়ায় তাহারা কৃষকদের উপযুক্ত মূল্য দিতে পারেন না। আপনারা কি একবার প্রশ্নও করিতে পারেন না যে, একটিমাত্র খালের দূরত্বে ভারত অপেক্ষাকৃত নিরেস পাটের মণপ্রতি মূল্য কমপক্ষে ৩৩ টাকা দিতে পারেন কিভাবে ? ভাইসব, এই ন্যায্যমূল্য না দেওয়ার পশ্চাতে গুরুতর চক্রান্ত আছে। এই চক্রান্ত হইতেছে ছলেবলে কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া দেওয়া আর পূর্ব পাকিস্তানীদের শৌর্যবীর্যকে পঙ্গু করিয়া দেওয়া। শেখ মুজিব আরও বলেন যে, আজ যদি আপনারা সংঘবদ্ধ না হন, আজও যদি আপনারা নিজেদের দায়িত্ব না বুঝেন, আজও যদি আপনারা কর্তব্যে অবহেলা করেন তবে আপনাদের পুত্র-পৌত্রাদি আপনাদের অবহেলা অবজ্ঞার জন্য অভিসম্পাত করিবে।
গতকল্যকার এই সভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব আবদুল বারি সভাপতিত্ব করেন। আওয়ামী লীগ নেতা খােন্দকার মােশতাক আহমদ, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সদস্য মেসার্স কামরুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক এম, পি, এ মেসার্স আমীর হােসেন ও মুন্সি আবদুল গণি সভায় বক্তৃতা করেন। ঢাকা হইতে আগত ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব সিরাজুল ইসলাম ও সিটি লীগের কর্মী মােহাম্মদ সুলতান পূর্বাহ্নে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব আবদুর রহমান খান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ষ্টেশনে অতিথিবৃন্দকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। ভৈরব ষ্টেশনে ভৈরব আওয়ামী লীগ কর্মিগণ আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। শেখ মুজিবর রহমান অদ্যই ঢাকা ফিরিয়া যান।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!