ইত্তেফাক
৬ই জুলাই ১৯৬৪
আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদসহ সকল পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ
সম্মিলিত বিরােধীদল কর্তৃক প্রেসিডেন্ট পদে একজন মাত্র প্রার্থী মনােনয়নে সম্মতি
প্রদেশব্যাপী ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক নির্যাতনের তীব্র নিন্দা
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
দেশবাসী কি পরিমাণে তাহাদের মৌলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়াছে তাহাই তাহাদের সমক্ষে তুলিয়া ধরার জন্য পূর্ব পকিস্তান আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পদ সহ আসন্ন নির্বাচনে পরিষদও মৌলিক গণতন্ত্রের সকল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে। এতদ্ব্যতীত ওয়ার্কিং কমিটি প্রেসিডেন্ট পদে সকল বিরােধী দল কর্তৃক একজন মাত্র প্রার্থী দাঁড় করানাের জন্যও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিয়াছে।
গতকল্য (রবিবার) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গৃহীত সর্ব সম্মত প্রস্তাবে আওয়ামী লীগের উপরােক্ত সিদ্ধান্ত ঘােষিত হয়। একজন মাত্র প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দাঁড় করানাের প্রশ্নে বিভিন্ন বিরােধী দলের সহিত সর্ব নিম্ন কাৰ্যসূচীর ভিত্তিতে আলাপ-আলােচনার জন্য কমিটি মেসার্স নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, শেখ মুজিবর রহমান এবং আবদুস সালাম খানকে ক্ষমতা প্রদান করে।
সভায় প্রদেশব্যাপী ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক নির্যাতনের নিন্দা করিয়া অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি, ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা, রাষ্টিকেশন, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, ডিগ্রী প্রত্যর্পণ এবং সুষ্ঠু শিক্ষা পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করার দাবী জানান হয়।
গতকল্য সকালে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির মুলতবী সভা শুরু হয়। বিশেষ আমন্ত্রণক্রমে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যগণও সভায় উপস্থিত ছিলেন।
গতকল্যকার ওয়ার্কিং কমিটির সভায় শাহ্ আজিজুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যপদে কো-অপ্ট করা হয়।ওয়ার্কিং কমিটি আওয়ামী লীগের সকল কমিটিকে আগামী ১২ই জুলাই ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস’ পালন করিতে আহ্বান জানাইয়াছে।
প্রস্তাবাবলী
গতকল্য (রবিবার) আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নরূপ প্রস্তাব গৃহীত হয়ঃ “যেহেতু বর্তমান শাসনতন্ত্রে দেশ শাসনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার সহ পাকিস্তানের জনসাধারণ তাহাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি হইতে বঞ্চিত হইয়াছে এবং যেহেতু আওয়ামী লীগ যেকোন উপায়ে জনসাধারণের পূর্ণ মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে দৃঢ়সঙ্কল্প, যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এই মত পােষণ করে যে, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচনে দুর্নীতির আশ্রয় গৃহীত হওয়ার ফলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিকূল ফলের লক্ষণ দৃষ্ট হইলেও জনসাধারণের সমক্ষে কি পরিমাণে মৌলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার হইতে তাহাদের বঞ্চিত করা হইতেছে তাহা তুলিয়া ধরিবার একটি পন্থা হিসাবে প্রেসিডেন্ট, পরিষদের সদস্য এবং মৌলিক গণতন্ত্রের আসন্ন নির্বাচনসমূহে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত।
“পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য দেশের সকল বিরােধী দল কর্তৃক যুক্তভাবে একজন প্রার্থী দাঁড় করানাে উচিত বলিয়া মনে করে এবং সে উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিম্নলিখিত সর্বনিম্ন লক্ষ্যের ভিত্তিতে অন্যান্য দলের সহিত আলােচনার জন্যে মেসার্স নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, শেখ মুজিবর রহমান এবং আবদুস সালাম খানের প্রতি দায়িত্ব অর্পণ করিতেছেঃ
(ক) পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ ফেডারেল ধরনের পার্লামেন্টারী সরকার; (খ) প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকার এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচন; (গ) পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সর্বপ্রকার বৈষম্য দূরীকরণ এবং দুই অঞ্চলের জন্য দুই অর্থনীতির ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ; (ঘ) সীমান্ত অপরাধ বিধিসহ সমস্ত নির্যাতনমূলক আইন বাতিল; (ঙ) বিনাবিচারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি; (চ) যাহাতে কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ সঞ্চয় সম্ভব না হইতে পারে এবং যাহাতে মধ্যম, নিম্ন এবং দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের ক্রমে ক্রমে এবং পর্যাপ্তভাবে করভার হাস হইতে পারে সেজন্য অর্থনৈতিক, রাজস্ব ও কর ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস।”
কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেশব্যাপী ছাত্র অসন্তোষ, রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক এবং শ্রমিকদের নির্যাতন ও জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে আলােচনার পর ওয়ার্কিং কমিটি নিম্নরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করে। “আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভা গভীর উদ্বেগের সহিত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্রমাগত তথাকথিত নিরাপত্তা আইন বলে বেপরােয়া গ্রেফতার, ফৌজদারী মামলা দায়ের, ডিগ্রী প্রত্যাহার, রাষ্টিকেশন ও বহিষ্কার, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধকরণ সহ ছাত্র সমাজের প্রতি ক্রমাগত নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয় লক্ষ্য করিতেছে। এই সভা ছাত্রদের প্রতি এই সব নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার নিন্দা করিতেছে এবং সরকারের প্রতি অবিলম্বে এইসব নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা বন্ধের দাবী জানাইতেছে এবং নিরাপত্তা আইন বলে আটক সকল ছাত্রের মুক্তি, ফৌজদারী মামলা, বহিষ্কারাদেশ, রাষ্টিকেশন প্রত্যাহার ও ডিগ্রী প্রত্যর্পণ এবং শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ তাহাদের সকল ন্যায়সঙ্গত দাবী মানিয়া লওয়ার মাধ্যমে ছাত্রদের স্বাভাবিক লেখাপড়ায় আত্মনিয়ােগ করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করার দাবী জানাইতেছে।”
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে তথাকথিত জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সবলে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের অযাচিত ও অযৌক্তিক গ্রেফতারের নিন্দা এবং সকল রাজবন্দীর অবিলম্বে বিনাশর্তে মুক্তি দাবী করা হয়। সভায় গভীর উদ্বেগের সঙ্গে প্রদেশের মাধ্যমিক শিক্ষকদের আসন্ন অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটের বিষয় বিবেচনা করা হয় এবং সরকারকে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবী মানিয়া লইয়া দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অচল না। হইতে দিতে আহ্বান জানান হয়। সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে সরকারকে পাট কল শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া মানিয়া লইয়া সমস্যার আপােষ-মীমাংসা করিয়া ধর্মঘট রােধ করিতে আহ্বান জানান হয়। ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি, বিপুল করের বােঝা এবং নয়া নির্জীব পাটনীতির ফলে জনগণের শােচনীয় অবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলােচনা করিয়া নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়ঃ যখন জনগণের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে, ঠিক সেই সময় নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির আতঙ্কজনক মূল্যবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন পর্যায়ে অস্বাভাবিক করবৃদ্ধিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিতেছে এবং সরকারকে এই অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হইয়া সঙ্গতমূল্যে নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়ার ব্যবস্থা করিতে ও মাত্রাতিরিক্ত করভারে জর্জরিত গরীব জনগণের করের বােঝা লাঘব করিতে আহ্বান জানাইতেছে।
সভার প্রস্তাবে ইতিমধ্যেই পাট মৌসুম শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়া যাহাতে পাটচাষীরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাইতে পারে তাহা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নিকট দাবী জানান হয়। বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আওয়ামী লীগের প্রাথমিক তথা ইউনিয়ন ইউনিট পুনর্গঠনের মেয়াদ ১৯৬৪ সালের আগষ্ট মাসের শেষ দিন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব