You dont have javascript enabled! Please enable it!

আজাদ
১৩ই জুলাই ১৯৬৪

জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ সগ্রামে ঝাপাইয়া পড়ার আহ্বান
জুলুম প্রতিরােধ দিবসের বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতা
বিভিন্ন নির্যাতন প্রতিরােধকল্পে জেলভীতি উপেক্ষার সংকল্প

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
“জুলুম প্রতিরােধ দিবস উপলক্ষে গতকল্য রবিবার পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবর রহমান বর্তমান সরকারের বহুমুখী জুলুমের অবসান-জুলুমকে উপেক্ষা করিয়া জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ আন্দোলনে শরীক হইতে আহ্বান জানান।
শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে যে পরােক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠীত হইবে উহাতে বিরােধীদল জয়লাভ করিলেও বর্তমানের একনায়কত্ববাদী সরকারকে অপসারণ করা যাইবে না, কারণ বর্তমানে ডিক্টেটরী শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে কামান ও বন্দুক রহিয়াছে। তাই তিনি ঘােষণা করেন যে, দেশব্যাপী জনসাধারণের উপর নানাভাবে যে মাত্রাধিক জুলুম চলিতেছে তাহার হাত হইতে বাঁচিতে হইলে এবং জনসাধারণকে তাহাদের অধিকার ফিরিয়া পাইতে হইলে বর্তমানের ডিক্টেটরী শাসন ব্যবস্থার অবসানের জন্য সর্বাত্মক সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িতে হইবে। তিনি আরও বলেন যে, এখন কেবল মাত্র আরাম কেদারার রাজনীতি দ্বারা দেশ হইতে জুলুমের অবসান করা যাইবে না। বরং সকলকে জেল ও নানা নির্যাতন স্বীকার করিয়া সক্রিয় আন্দোলন করিতে হইবে।
শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ দেশের অন্যান্য সকল বিরােধী দলের সহিত একযােগে আন্দোলনে অগ্রসর হইতে সঙ্কল্পবদ্ধ রহিয়াছে। যে কোন বিরােধীদল বর্তমানের এই শ্বাসরােধকারী অবস্থার অবসানের জন্য আন্দোলনের মাধ্যমে অগ্রসর হইবেন, আওয়ামী লীগ তাহাদের সকলের সহিত কাঁধ মিলাইয়া অগ্রসর হইবে। তবে যাহারা গরম পানিতে হাত ডুবাইতে ভয় পান, সেই ধরনের আরামপ্রিয় রাজনীতিকদের সহিত একযােগে কাজ করিতে আওয়ামী লীগ সক্ষম হইবে না। তিনি আরামপ্রিয় রাজনীতিকদের প্রতি এক আবেদনে বলেন যে, বর্তমানের জঞ্জাল সাফ করার সংগ্রামী আন্দোলনের পর যখন অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হইবে তখন আওয়ামী লীগ সেই সকল আরামপ্রিয় নেতাদের নেতা হিসাবে মানিয়া লইতে প্রস্তুত রহিয়াছে। সুতরাং বর্তমানে তাহাদিগকে মিছামিছি বদনাম প্রচার শুরু করিয়া দেশের সর্বনাশ করা হইতে বিরত থাকার জন্য তিনি অনুরােধ জানান।
শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধানতঃ যে পাঁচটী বিষয়ের প্রতি নাগরিকগণ বিশেষভাবে আগ্রহান্বিত থাকেন বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানীগণ উক্ত ৫টি বিষয় হইতে বঞ্চিত রহিয়াছেন। তিনি বলেন যে, দেশের রাজধানী করাচীতে স্থাপন করিয়া পূর্ব পাকিস্তান হইতে বৈদেশিক মুদ্রারূপে অর্জিত ১২শত কোটি টাকা করাচীর উন্নয়নে ব্যয়িত হইয়াছিল। এখন উক্ত ফেডারেল রাজধানী অন্যত্র অপসারিত হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরী-বাকুরীতে সমগ্র দেশের শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসী অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান হইতে শতকরা দশজনও নিযুক্ত নাই। তৃতীয়তঃ পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন সৃষ্টি করা হয় নাই। বরং সমগ্র পাকিস্তানের মােট সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগই দুইশত পরিবারের কুক্ষিগত করিয়া তাহাদের একচেটিয়া মূলধনের সুযােগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। চতুর্থতঃ সামরিক বিভাগের সুযােগ হইতে পূর্ব পাকিস্তানীরা বঞ্চিত রহিয়াছে এবং স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদর দফতর সব কয়টিই পশ্চিম পাকিস্তানে রাখা হইয়াছে। পঞ্চমতঃ জনসাধারণের অধিকারের রক্ষা কবচ পার্লামেন্টরূপে বর্তমানে সাৰ্বভৌম কোন সংস্থা নাই। বরং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তাহার শাসনতন্ত্র কমিশনের সােপারেশকেও উপেক্ষা করিয়া এক অভিনব শাসনতন্ত্র জারী করিয়াছেন। শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, ১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র ছাড়া অপর কোন শাসনতন্ত্রই দেশবাসী মানিয়া লইবে না। শেখ মুজিবর রহমান অভিযােগ করেন যে, দ্বিতীয় পাচসালা পরিকল্পনায় বর্তমান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় ১৩৫০ কোটি টাকা। তথাকার লবণাক্ততা দূর করার জন্য ১৫০০ কোটি টাকা এবং এছলামাবাদে নয়া রাজধানী নির্মাণ বাবদ ৫শত কোটি টাকা ব্যয় করিতেছেন। অথচ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হইবে মাত্র ৯৫০ কোটি টাকা। অপর দিকে এই প্রদেশে বন্যার লক্ষ লক্ষ একর জমির উর্বরতা বিনষ্ট হইতেছে এবং কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস হইতেছে। তিনি পরিশেষে আগামী নির্বাচনে দেশবাসীকে প্রার্থী নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করিতে বলেন এবং যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সকলকে প্রস্তুত থাকিতে আহ্বান জানান।
এই সময় সভাস্থ বিরাট জনতা হাত তুলিয়া তাহাদের সংকল্প প্রকাশ করিলে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, তাহাকে ২/৪ দিনের মধ্যেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে জেলে নিক্ষেপ করিলেও তিনি জনসাধারণকে আন্দোলনে প্রস্তুত দেখিয়া ভবিষ্যৎ সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত মনে জেল-জুলুম স্বীকারে প্রস্তুত রহিয়াছেন।
জনসভার সভাপতি মওলানা তর্কবাগীশ ঘােষণা করেন যে, যে কোন প্রতিবন্ধকতাই আসুক না কেন সংগ্রামের ঐতিহ্যপূর্ণ আওয়ামী লীগ মস্তক অবনত করিবে না। তিনি বলেন যে, সত্য সংগ্রামের সংঘবদ্ধ শক্তিকে কেহই পরাজিত করিতে পারিবে না, কারণ সঙ্গীনের শাসন বেশীদিন স্থায়ী হয় না। তিনি সংবাদপত্র দলন, শিক্ষক ও শ্রমিক নির্যাতনেরও ফিরিস্তি দেন। এছাড়া বর্তমান শাসনতন্ত্রের দ্বিতীয় সংশােধনী বিল পাশ করাইবার জন্য জাতীয় পরিষদের সদস্যদের বিশেষ করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের উপর যে অমানুষিক চাপ প্রয়ােগ করা হয় করাচীর একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক হইতে উদ্ধৃতি দিয়া তাহার বিশদ বিবরণ দেন। সভায় খন্দকার মােশতাক আহমদ ও জনাব সিরাজুল ইসলামও বক্তৃতা করেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!