ইত্তেফাক
৭ই জুলাই ১৯৬৪
আওয়ামী লীগ নীতিতে বিশ্বাসী
-শেখ মুজিবর রহমান
নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলনে জনাব শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতার অবশিষ্ট বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইলঃ
রাজনীতিতে ৪টি জিনিস প্রয়ােজন নীতি, নেতা, কর্মী ও প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগের নীতি আছে, নীতির মাধ্যমে নেতা আছেন, কর্মী আছেন, প্রতিষ্ঠান আছে। জনগণের জন্য সংগ্রামই আওয়ামী লীগের নীতির মূলকথা। সারা দেশে সংগ্রামী ঐতিহ্য বলিতে একমাত্র আওয়ামী লীগেরই আছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবীতে জনগণের পক্ষে সংগ্রাম করিতে গিয়া হাজারে হাজারে কারাবরণ করিয়াছে, নির্যাতিত হইয়াছে, পুলিসের হামলার সামনে বুক পাতিয়া দিয়াছে। আওয়ামী লীগের নেতা, দেশের অবিসংবাদিত জননেতা জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন। অসম সাহসী এই সংগ্রামী পুরুষকে তাই বৃটিশ সরকারও কোন দিন কারাগারে নিক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টি করিতে পারে নাই। কিন্তু স্বাধীন দেশের অবিসংবাদিত জননেতার আসনে যখন তিনি সমাসীন, তখন নিজ দেশের সরকারের হাতেও জীবন-সায়াহ্নে তাঁহাকে জনগণের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া সগ্রাম করিতে গিয়া কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইতে হইয়াছে। কারাগার হইতে যে ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া তিনি বাহিরে আসেন, সেই ভগ্নস্বাস্থ্যই হয় তাহার কাল। দেশকে কাঁদাইয়া, দেশবাসীকে কাঁদাইয়া সুদূর বিদেশ-বিভুঁইয়ে আত্মীয়-পরিজন বর্জিত পরিবেশে তাঁহাকে বিদায় লইতে হইয়াছে। আওয়ামী লীগ নীতিতে বিশ্বাসী বলিয়াই সব কিছু তাঁহারা মাথা পাতিয়া বরণ করিতে পারিয়াছে। আমরা বাঙালী, আমরা মুসলমান, তাই সহজেই সব ভুলিয়া যাই। পাকিস্তানের জীবনে সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিয়া দেশে যখন সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা সম্পন্ন-প্রায়, তাহারই মাত্র ৪মাস পূর্বে কেন হঠাৎ দেশ রসাতলে যাওয়ার প্রশ্ন তুলিয়া সামরিক শাসন প্রবর্তন করা হইল, সে প্রশ্ন কেহ তুলিল না। হাজার হাজার নেতা ও কর্মী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইল, শত শত কর্মীকে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হইল, সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হইল, এসব প্রশ্ন কাহারও মনে দাগ কাটিল না। সামরিক শাসন জারি করিয়া ক্ষমতা দখল করা হইল, সেই আনন্দে সবাই নাচিল। দেশের জন্য যারা সর্বস্ব দিল, জেলজুলুম, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইল, তারা তাদের কেউ নয়। বাংলার গ্রামে গ্রামে রটিয়া গেল নিউমার্কেটে শেখ মুজিব সিনেমা হল করিয়াছে, সামরিক সরকার তাঁহাকে পাকড়াও করিয়াছে, এবার নির্ঘাত ফাসি। আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরা ধরা পড়িয়াছে, চুরি, জোচ্চুরী, জারি জুরি এবার সব আইয়ুব সরকারের শ্বেতপত্রে ফাস হইয়া যাইবে। ৪ বত্সর যাবৎ সামরিক শাসন চলিল, কোথায় গেল শেখ মুজিবের সে সিনেমা হল, কোথায় গেল তার ফাঁসি আর কোথায় গেলইবা আওয়ামী লীগ মন্ত্রীদের কুকীর্তির সে ফিরিস্তি। সদাশয় সরকার “মাছ না পাইয়া ছিপে কামড় দিলেন। দেশবাসীর পক্ষে যাতে কেহ কথা বলিতে না পারে তজ্জন্য মহাজনী পন্থা আবিষ্কার করিলেন। জনগণের যাঁহারা নেতৃত্ব দিয়াছেন তাহাদের সকলকে এবডাে করিয়া রাজনীতি হইতে বিদায় দিয়া নিজেদের শােষণের পথ নিরঙ্কুশ করা হইল। দেশবাসী সব নীরবে দেখিল।
এই তাে আমাদের চরিত্র। এ চরিত্র না বদলাইলে কেবল বাঙালীর নয়, জাতির ভবিষ্যৎও অন্ধকার। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা ৩টি কাগজই পড়েইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ। সব কাগজ বাদ দিয়া একের পর এক যা কিছু হামলা চালানাে হইতেছে এই তিনটি কাগজের উপর। শ্রমিকরা বাঁচার মত পারিশ্রমিকের দাবী জানাইয়া ব্যর্থ হইলে ধর্মঘটের উদ্যোগ গ্রহণ করিতেই আজ সে ধর্মঘট বে-আইনী ঘােষিত হয়। ডাক্তাররা ধর্মঘট করিলে রােগী সাধারণের অবস্থা যা-ই হােক না কেন, সরকার সে ব্যাপারে নির্বিকার। পরে ডাক্তাররা কার্যে যােগদান করিলে তাহাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইলেও সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না। স্বভাবতঃই রােগীর চিকিৎসা ছাড়িয়া আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইতেই তাঁহাদের সময় চলিয়া যায়।
সরকার বহু খেল দেখাইবার পর সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়াইলেন। পদস্থদের আঙ্গুল ফুলিয়া কলা হইল, গরীব কর্মচারীদের বেতন বাড়িল না। বিশ্বাস না হয় খাস সেক্রেটারীয়েটের পিওন-আর্দালিদের গিয়া জিজ্ঞাসা করুন, তাহারা বলিবে।
দেশে উন্নয়ন নাকি আকাশ ছুঁই ছুঁই করিতেছে। জিজ্ঞাসা করি বিনা ক্ষতিপূরণে গরীব চাষী মজুরের জমির উপর দিয়া রাস্তার নামে মাটি ফেলিয়া জনসাধারণের নাকি পরম উপকার করা হইয়াছে। বলি, এ পরম উপকারের পাশাপাশি গরীব জনসাধারণের উপর ট্যাক্সের যে বােঝা চাপানাে হইয়াছে। সরকার তাহার হিসাবটি প্রকাশ করেন না কেন? তাহা তাঁহারা করিবেন না; কারণ, কত টাকা ট্যাক্স দিয়া গ্রামের চাষীরা ক’ টাকার উপকার পাইয়াছে তাহার সব জারি-জুরি যে তাহাতে ফাঁস হইয়া যায়। দেশ না কি শিল্পে ছাইয়া গিয়াছে। অস্বীকার করি না, দেশের অনেক লক্ষপতি এঁদের আমলে কোটিপতি বনিয়াছেন। অনেক পদস্থ সামরিক কর্মচারী বে-সরকারী বিভাগে অধিক বেতনে চাকুরী পাইয়াছেন, অনেকে আবার রাতারাতি শিল্পপতিও বনিয়াছেন। সামরিক বাহিনী ইহাতে দুর্বল হইতেছে কি-না, কে জানে? দেশে বহু আকাশচুম্বী ইমারতও উঠিয়াছে। কিন্তু দরিদ্র জনসাধারণের কি হইয়াছে? আজ তাহারা যা বিক্রী করে তাহার দাম কম- যাহা কিনে তাহার দাম বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশের বাজারে প্রতিযােগিতায় দাঁড়াইতে পারে না, সুতরাং তাই বাজার দরকার। অতএব বাংলা দেশকেই বাজার না করিয়া আর উপায় কি? স্বভাবতঃই পূর্ব পাকিস্তান আজ পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প মালিকদের বাজারে পর্যবসিত।
সখের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে না। আওয়ামী লীগ নীতির রাজনীতি করে। তাই কোন সময় পুলিসের গাড়ী আসিয়া তুলিয়া লইবে তাহার জন্য আমরা প্রস্তুত হইয়াই থাকি। যাহাতে পুলিসের লােককে আসিয়া বসিয়া থাকিতে না হয় তাহার জন্য কারাগারে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি লইয়াই আমরা বসিয়া থাকি। তাই আমার সংগ্রামী কর্মীভাইদের প্রতি আমার অনুরােধ, কেতাদুরস্ত পােশাকে ভূষিত কাহারও দু’কথা ইংরেজী-উর্দুর বােলচাল শুনিয়া গলিয়া গিয়া সংগ্রামের পথ ত্যাগ করিবেন না। স্মরণ রাখিবেন বাংলা মীরজাফরেরা যে কারণেই সংগ্রাম করুন না কেন, আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। ভবিষ্যৎ বংশধররা যাতে গােলামে পরিণত না হয়, আমাদের সংগ্রাম তার জন্যই। ব্যবসায়ে আজ বাঙ্গালীর স্থান নাই, বাণিজ্যে আজ বাঙ্গালীর স্থান নাই, চাকুরীতে নাই, বসতিতে নাইআছে কোথায়?
শরীয়তুল্লা, তিতুমীর, সুভাষ, সােহরাওয়ার্দী, নজরুলের দেশের মানুষ ‘শ্বেতের’ বদলে ‘পীতের’ শাসন চায় নাই, চাহিয়াছে স্বাধীন দেশে স্বাধীন। মানুষের মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইতে।
পাকিস্তানের ১০ কোটি মানুষের আশা-আকাংক্ষাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করিতে আজ প্রয়ােজন সংঘবদ্ধ সুশৃংখল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। সুশৃংখল দশ হাজার কর্মীর পক্ষে যাহা সম্ভব, বিশৃংখল লক্ষ লােকের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। এই কথা মনে রাখিয়া কর্মী ভাইদের আমি কার্যক্ষেত্রে ঝাপাইয়া পড়ার আহ্বান জানাই।
সংগ্রামে সবাইকে সঙ্গে লইতে আমরা রাজী। তবে পলাশীর আম্র কাননের ইতিহাস স্মরণ করাইয়া দিয়া আমি বলিব, জয় যখন সুনিশ্চিত তখন রাত্রে বিশ্রাম লইয়া ভােরের বেলায় পূর্ণ বিক্রমে ক্লাইভের সৈন্যের উপর আবার আমরা ঝাপাইয়া পড়িব- এমি কথায় নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে বিভ্রান্ত করার কলঙ্ককর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির পথ প্রশস্ত করিতে পারেন- এমন কাহাকেও সঙ্গে লইতে আমরা রাজী নহি। কর্মী ভাইদের উদ্দেশে তাই আজ আমার বক্তব্য, আগামী দিনের সর্বাত্মক সংগ্রামের মুখােমুখি দাঁড়াইয়া আজ আপনারা অমর আত্মা শহীদের চেহারা স্মরণ করুন। নীতির জন্য যিনি আজীবন সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন, নীতির জন্য যিনি প্রাণ বিসর্জন দিয়াছেন, অকুতােভয় যে নির্ভীক বীরকে ইংরেজ সরকারও কারাগারে নিক্ষেপের সাহস পায় নাই, সেই নেতাকেই নিজ দেশের সরকারের হাতে জীবন সায়াহ্নে কারাবরণ করিয়া, নানাভাবে নির্যাতিত- লাঞ্ছিত হইয়া যে আক্ষেপ লইয়া সুদূর বিদেশে-বিভুয়ে আত্মীয়-পরিজন বর্জিত পরিবেশে প্রাণ বিসর্জন দিতে হইয়াছে, সেই নেতার আত্মা কখনও শান্তি পাইতে পারে না। যদি না আমরা তাঁর সে সংগ্রামকে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছাইতে পারি। আমেরিকায় জন্ম নিলে আমার নেতা কেনেডীর সমকক্ষ হইতেন কি-না জানি না, বৃটেনে জন্ম নিলে আমার নেতা চার্চিলের সমকক্ষ হইতেন কি-না জানি না, ভারত ত্যাগ করিয়া না আসিলে আমার নেতা জওয়াহের লালের নেতৃত্বকে অভিভূত করিতে পারিতেন কি-না জানি না, কিন্তু একথা বিশ্বাস করি যে, যে নেতা না হইলে পাকিস্তানই হয়তাে দিবালােকের মুখ দেখিত না, সেই নেতাকে শেষ জীবনে যে অপমান সহ্য করিতে হইয়াছে, তার প্রতিশােধ লইতে হইলে কাল বিলম্ব না করিয়া দেশে অত্যাচার-অবিচারের অবসান ঘটাইয়া পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দুর্জয় সংকল্প লইয়া আপনারা কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়ুন, ইহাই আমি চাই।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব