You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.07.13 | জুলুম প্রতিরােধ দিবসের বিশাল জনসমাবেশে ক্ষমতাসীনদের প্রতি শেখ মুজিবের কঠোর হুঁশিয়ারি | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
১৩ই জুলাই ১৯৬৪

‘এই বাংলার ইতিহাস আপনারা জানেন না, একবার যদি এই বাংলা রুখিয়া
দাঁড়ায়, তবে-
‘জুলুম প্রতিরােধ দিবসের বিশাল জনসমাবেশে ক্ষমতাসীনদের প্রতি
শেখ মুজিবের কঠোর হুঁশিয়ারি
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক সরকারী মুখপাত্রদের পূর্ব দিনের বক্তৃতার
চুলচেরা সমালােচনা
অধিকার আদায়ের সর্বাত্মক সংগ্রামে শরিক হওয়ার জন্য চরম ত্যাগ
স্বীকারের প্রস্তুতির আহ্বান

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
“এই ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের অসম্মান ঘটাইয়া মাত্র ৪ হাজার লােকের ‘বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করিতে গিয়া শনিবারে এক মন্ত্রী ভায়া বলিয়াছেন, এ দেশে বিরােধীদল বলিয়া কিছু আছে বলিয়া তিনি জানেন না। জবাবে পল্টন ময়দানের আজিকার এই বিশাল জনসমুদ্রকে সাক্ষী রাখিয়া আমি বলিব, মন্ত্রীভায়া! বাংলার ইতিহাস আপনি জানেন না। এই বাংলা মীরজাফরের বাংলা। আবার এই বাংলাই তীতুমিরের বাংলা, এই বাংলা হাজী শরীয়তুল্লার বাংলা, এই বাংলা সুভাষ-নজরুল-ফজলুল হক- সােহরাওয়ার্দী মওলানা ইসলামাবাদীর বাংলা। এই বাংলা যদি একবার রুখিয়া দাঁড়ায়, তবে আপনাদের সিপাই-বন্দুক, কামান-গােলা সবই স্রোতের শেওলার মত কোথায় ভাসিয়া যাইবে, হদিসও পাইবেন না। মন্ত্রীভায়াকে আরও বলি, জনগণের ভােট ফিরাইয়া দিয়া আপনাদের নেতাকে নির্বাচনে নামান- যদি শতকরা ২০টা ভােটও আপনারা পান, তবে আজীবনের জন্য তাহাকে আমরা প্রেসিডেন্ট হিসাবে বরণ করিব- আর তা যদি না পান, তবে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার মত ভাগ্য বরণের জন্য আপনাদের প্রস্তুত থাকিতে হইবে।” ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস উপলক্ষে গতকল্য ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান অযুতকণ্ঠের ‘জিন্দাবাদ ধ্বনি ও তুমুল করতালির মধ্যে জলদগম্ভীর কণ্ঠে উপরােক্ত ঘােষণা করেন।
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সামরিক শাসনােত্তর যুগের আওয়ামী লীগের এই প্রথম জনসভার কলেবর যেন এইদিনের প্রত্যেকটি বক্তা ও শ্রোতাকে অধিকার আদায়ের আগামী দিনের সর্বাত্মক সংগ্রামে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করিয়া তুলে। এই জন্যই এইদিনের সভার প্রত্যেক বক্তার কণ্ঠেই কেবল জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনীই ধ্বনিত হয় নাই- পূর্বদিনের সভায় সরকারী লীগের নেতৃবৃন্দ তথা মন্ত্রীদের বক্তৃতার চুলচেরা সমালােচনাও ধ্বনিত হইয়াছে।
অত্যাচার-নির্যাতন আর জেল-জুলুমের করুণ কাহিনী বর্ণনার পর সভার প্রধান বক্তা শেখ মুজিবর রহমান এক এক করিয়া সরকারী লীগের মুখপাত্র ও মন্ত্রীদের অভিযােগের জবাব দিতে থাকিলে শ্ৰোতৃমণ্ডলী তুমুল করতালি ও জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে বক্তার বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানাইতে থাকেন। বক্তৃতার শেষভাগে শেখ মুজিব জলদগম্ভীর কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, এবারকার সংগ্রাম আমাদের সর্বাত্মক সংগ্রাম, এবারকার সংগ্রাম আমাদের ‘বাচিব কি মরিব’র সংগ্রাম, এবারকার সংগ্রাম আমাদের অধিকার পাইব কি পাইব না’র সংগ্রাম। এ সংগ্রামে অনেককে হয়তাে ফাসি কাষ্ঠেও ঝুলিতে হইতে পারে। এই ঘােষণার সাথে সাথে শেখ মুজিব উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে ‘এই সংগ্রামে নামিয়া ফাসি কাষ্ঠে ঝুলিতে রাজী আছেন কে কে বলিয়া প্রশ্ন করিতেই সমগ্র জনসমুদ্র একযােগে হস্তোত্তলন করিয়া অধিকার আদায়ের চরম ত্যাগ স্বীকারের সংকল্প জ্ঞাপন করেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে দুই মিনিটব্যাপী জিন্দাবাদ ধ্বনিতে সমগ্র ময়দান মুখরিত হইয়া উঠে। মুখরতার এই রেশ না মিলাইতেই শেখ মুজিব উপস্থিত জনসাধারণকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিবার প্রস্তুতির পরিবর্তে কেবল জেলে যাইবার প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানাইয়া বলেন, কাল আমার দেশদ্রোহিতার মামলার দিন। আসামীর কাঠগড়ায় গিয়া দাঁড়াইবার পূর্ব মুহূর্তে পল্টনের এই জনসমুদ্রের মাঝে যে আশা, যে ভরসা আর যে দুর্দমনীয় তেজের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়া গেলাম, ইহাই আমাদের আগামী দিনের একমাত্র সম্বল, একমাত্র পাথেয়। এই পাথেয় যাহাদের আছে, কোন শক্তিই তাহাদের পরাভূত করিতে পারে না। জনগণের প্রাণবহ্নির সম্মুখে নমরুদ-ফেরাউন যখন টিকে নাই, হিটলার-মুসােলিনি যখন টিকে নাই, তখন লক্ষ কোটি নিরন্ন বুভুক্ষুর ক্রোধানলের সম্মুখে এদেশের ক্ষমতাসীনরাও টিকিবে না।
মন্ত্রীদের অভিযােগের জবাব
বক্তৃতার এক পর্যায়ে শেখ মুজিব বলেন, গতকাল এই পল্টন ময়দানে দাঁড়াইয়া আমার ‘সবুর ভাই’ অভিযােগ করিয়াছেন জনাব শাহেদ আলীর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়া ‘ধিকৃত’ রাজনীতিকরাই এদেশে সামরিক শাসন ডাকিয়া আনিয়াছিল। শেখ মুজিব বলেন, মরহুম শাহেদ আলী আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। সুতরাং আওয়ামী লীগ সরকার নিশ্চয়ই তাহাকে হত্যা করেন নাই- তাহা হইলে তাহাকে হত্যা করিল কে ?
শেখ মুজিব অতঃপর অভিযােগ করেন যে, মরহুম শাহেদ আলীর হত্যার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। আর দেশে সামরিক শাসন জারির ক্ষেত্র প্রস্তুতই ছিল সে ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য। এই কারণেই সামরিক শাসন জারির পর মরহুম শাহেদ আলীর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বন্ধ করা হয়। জিজ্ঞাসা করি, ‘ধিকৃত রাজনীতিরাই যদি শাহেদ আলীর হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন, তবে সামরিক সরকার সে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বন্ধ করিলেন কেন ? কেনইবা তাহার হত্যাকারীদের বিচার করা হইল না ? শেখ মুজিব বলেন, এ প্রশ্নের জবাবও আমাদের অজানা নাই। আমরা জানিতাম শাহেদ আলী হত্যার তদন্ত করা হইলে অনেক রহস্য ফাঁস হইয়া পড়িত। তাই, ‘ন্যায় বিচারের’ আসনে বসিয়া সামরিক সরকার আমার মত অনেক অভাগার উপর বিভিন্ন অভিযােগে জেল-জুলুম আর অত্যাচার নির্যাতনের বন্যা বহাইয়া দিলেন কিন্তু শাহেদ আলীর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বা বিচারের প্রশ্নে টু শব্দটিও করিলেন না। জনাব সবুরের দাবীটিকে সম্পূর্ণ অসার ও মিথ্যা বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া শেখ মুজিব জনাব সবুরের উদ্দেশ্যে পাল্টা প্রশ্ন করেনঃ শাহেদ আলী হত্যাকাণ্ডই যদি দেশে সামরিক শাসন জারির কারণ হইবে তবে জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি, আজ যেখানে আপনারা রাজধানী করিয়াছেন, সেই রাওয়ালপিণ্ডির প্রকাশ্য জনসভায় দিনে দুপুরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে যখন হত্যা করা হইল, তখন কেন দেশে সামরিক শাসন জারি করা হইল না? জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি, ১৯৫২ সালে যখন মজহাবী হাঙ্গামায় পশ্চিম পাকিস্তানে রক্তের বন্যা বহিয়া গেল, তখন কেন সামরিক শাসন জারি করা হইল না? জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি, ১৯৫৩ সালে জনাব গােলাম মােহাম্মদ যখন পার্লামেন্ট ভাঙ্গিয়া দিয়া খাজা নাজিমুদ্দীনকে বরখাস্ত করিয়া দেশে মারাত্মক শাসনতান্ত্রিক সংকট সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তখন কেন সামরিক শাসন জারি করা হইল না? তাই বলি, দেশে সামরিক শাসন জারির কারণ জনাব শাহেদ আলীর হত্যাকাণ্ড, না অন্য কিছু? বরং সামরিক শাসন জারির কারণ কি এই নয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ১৫টি উপনির্বাচনের একের পর এক ১৪টিতেই আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত হইতে দেখিয়া এবং আওয়ামী লীগের গণস্বার্থ মুখ্য ভূমিকাদৃষ্টে এদেশের উপরতলার একশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থী মহলের টনক নড়িয়া যায়। তাই দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের মাত্র ৪ মাস বাকী থাকিতে তাহারা যখন আসন্ন নির্বাচনের ফলাফল আঁচ করিতে পারেন। বিশেষ করিয়া যখন তাহারা বুঝিতে পারেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ যদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লইয়া ক্ষমতায় আসে তবে পূর্ব পাকিস্তানের পাওনা কড়ায় গণ্ডায় তাহারা শােধ করিয়া লইবে, তখনই তাহারা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আর সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শেষ খুঁটি চালা হয় দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের মাত্র ৪ মাস আগে দেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে আর তার প্রধান শিকার হয় আওয়ামী লীগ ও তার নেতা দেশবরেণ্য জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। জনাব সবুরের দ্বিতীয় অভিযােগের জবাবে শেখ মুজিব দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৮২৬ জন রাজবন্দী কারাগারে আটক ছিলেন, এমন কথা কেবল বেহায়া ছাড়া আর কেউ বলিবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগই সর্বপ্রথম কারাগার হইতে সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিয়াছিল। কেবল তাহাই নয়, নিরাপত্তা আইনও তাহারা সমূলে বাতিল করিয়াছিল। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি নিরাপত্তা আইন বলবৎ রাখিত এবং সবুর ভাইদের যদি জেলে পুরিয়া দুইদিনের জন্যও ‘লাচ্ছি, খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিত, তবে আজ আর তাঁহারা নিরাপত্তা আইনের গুণগান করিতেন না। দেশের উভয় অংশের বৈষম্যের জন্য বিরােধীদলীয় নেতাদের প্রতি জনাব সবুর যে কটাক্ষ করেন তাঁহার জবাবে শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১০ বৎসর যাবৎ দেশে যে দল ক্ষমতাসীন ছিলেন, জনাব সবুর নিজেও সেই দলের সদস্য ছিলেন। বৈষম্যের গােড়াপত্তনও তাঁহাদের আমলেই। মাঝে মাত্র তেরাে মাসের জন্য পরিষদে ১২ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ অন্যের কাঁধে ভর করিয়া ক্ষমতাসীন হয়। এই সামান্য সময়ে তাঁহারা বৈষম্য নিরসনের জন্য চেষ্টা পান। কিন্তু কুচক্রী মহলের আঁতে ঘা লাগায় ক্ষমতার আসন হইতে তাহাদের নামিয়া আসিতে হয়। বর্তমান সরকারের আমলের একটি মাত্র নজির তুলিয়া শেখ সাহেব জনাব সবুরের নিকট জানিতে চাহেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের আমলে প্রণীত দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে পূর্ব পাকিস্তানে দেশের শতকরা ৫৬ জন লােকের বাস সেই পূর্ব পাকিস্তানকে মাত্র ৯৫০ কোটি টাকা দিয়া যে পশ্চিম পাকিস্তানে দেশের শতকরা ৪৪ জনের বাস সেই পশ্চিম পাকিস্তানকে ১৩৫০ কোটি টাকা দেওয়া এবং তদুপরি এই পরিকল্পনার বাহিরে রাখিয়া সিন্ধু অববাহিকা পরিকল্পনা ও লবণাক্ততা দূরীকরণের জন্য ১৫০০ কোটি টাকা ও ইসলামাবাদে রাজধানী নির্মাণের জন্য ৫০০ কোটি টাকা সর্বসাকুল্যে পশ্চিম পাকিস্তানকে ৩৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা কোন ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা? পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এ কোন ধরনের সুবিচার ? ইহারই পাশাপাশি শেখ সাহেব ক্ষমতাসীনদের প্রতি প্রশ্ন করেন, বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ একর জমি নষ্ট হইয়া যায়, অথচ এই অবস্থা নিরসনের জন্য ক্রুগ মিশনের প্রস্তাবিত ১০০০ কোটি টাকা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করার মত মানসিকতা ক্ষমতাসীনরা পান না, কিন্তু পরিকল্পনার বাহিরে রাখিয়া ২০০০ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা সম্ভব হয়। ইহা কোন যুক্তিতে?
দেশের বিগত ১৭ বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির চুলচেরা বিবরণ দিয়া। (বিস্তারিত বিবরণ আগামী বৃহস্পতিবারের ইত্তেফাকে প্রকাশিত হইবে) উপসংহারে শেখ মুজিব দৃপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করেন, লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান আসিয়াছিল- সেই লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিতে হইবে, দেশ শাসন করিতে হইবে, অন্যথায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচিবার উপায় নাই।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব