ইত্তেফাক
১৬ই জুলাই ১৯৬৪
‘জুলুম প্রতিরােধ দিবসের জনসভায় শেখ মুজিবরের বক্তৃতার অবশিষ্টাংশ
আওয়ামী লীগ আর যা-ই করে থাকুক
পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কখনও করেনি…
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
১৭ বছর পরে আবার জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নামতে হবে, ১৭ বছর পরে আবার ভােটের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হবে, ১৭ বছর পরে আবার রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হবে-একথা কোনদিন ভাবিনি। নিজ দেশে নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধেও বৃটিশ আমলের মত জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে, ভাবলে মন আমার শিউরে ওঠে।
গত কদিনে দিনাজপুরের পঞ্চগড় থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের কক্সবাজার পর্যন্ত সিলেটের সীমান্ত থেকে বরিশাল পর্যন্ত ঘুরেছি। অন্ততঃ ৬০টি জনসভায় বক্তৃতা করেছি- দাবী করেছি, প্রস্তাব পাস করেছিঃ জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দাও, বাঁচার মত বাঁচতে দাও। কিন্তু ফল কিছুই হয়নি; সরকার কানে তুলাে দিয়েছেন।
আজ জুলুম প্রতিরােধ দিবসের সভায় দাঁড়িয়ে মনে পড়ে সেই দিনটির কথা, যেদিন ১৯৫৮ সালে ‘আল্লার রহমতে এস্কান্দর মীর্জা আইয়ুব খানের বন্দুক দিয়ে ‘ধিকৃত’ রাজনীতিকদের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করেছিলেন।
গতকাল এইখানে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী- লীগের জনাব সবুর শাহেদ আলীর হত্যার প্রসঙ্গ তুলে দেশে সামরিক শাসন জারির ‘মরতবা বিশ্লেষণ করে গিয়েছেন। (সামরিক শাসন জারির প্রশ্নে শেখ সাহেব মন্ত্রী জনাব সবুরের বক্তৃতার জবাব দিয়ে তাঁর উদ্দেশে যে সব পাল্টা প্রশ্ন তুলে ধরেন, তার বিবরণ গত সােমবারের ‘ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে)।
সামরিক শাসন জারির কারণ ব্যাখ্যা করে ‘সবুর ভাই সেদিনকার সামরিক শাসনের যে প্রশস্তি গেয়েছেন, তা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব; কেননা সামরিক শাসন জারির পর তাঁর প্রতি সামরিক শাসনকর্তার যে নেক নজর’ পড়েছিল, তার স্মৃতিই হয়তাে তাকে এ প্রশস্তি গাইতে উদ্বুদ্ধ করে।
দুঃখ আমার এইখানে-
দুঃখ আমার এইখানে যে, বাংলা দেশের মানুষ প্রথমে বুঝতে পারে না। পরে যখন বােঝে, তখন কেবল আক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই তাদের করার থাকে না। দেশে মার্শাল ল জারি করে শাসনতন্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হল, নেতৃবৃন্দকে ‘ধিকৃত’ রাজনীতিক আখ্যা দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হল, অসংখ্য রাজনীতিক ও হাজার হাজার কর্মীকে জেলে ঠেলে দেয়া হল। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হল- অত্যাচার নির্যাতনের বন্যা বয়ে গেল, ভাইরা আমার ক্ষমতা দখলকারীর জিন্দাবাদে মসগুল হয়ে উঠল।
বাঙ্গালীর যা চরিত্র
বাঙ্গালীর যা চরিত্র, গতকাল পল্টন ময়দানে তারই আর একবার পরিচয় পাওয়া গেল। মন্ত্রী হয়ে সবুর ভাইর মুখে কত খৈ ফুটল।
বিরােধীদলের বিরুদ্ধে বিষােদগার করতে করতে নূরুল আমীনকে সভার কার্যকলাপেরও তিনি তীব্র সমালােচনা করে গেলেন। হাজার লােকের ‘বিরাট জনসভায় শ্রোতাদের তিনি ধারণা দিয়ে গেলেন যে, অতীতের সরকারই যা অনাসৃষ্টির মূল- আর তিনি নিজেও গভর্নর মােনেম … বেহেশতের গদির মােহে সবুর ভাইর সব ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক।
জনাব সবুর তখন সেই দলেরই প্রচার সম্পাদক
চোখে যার তুলি বাধা, জনগণকে বােকা ঠাউরে আত্মপ্রসাদ লাভ করা কেবল তারই সাজে। এই জন্যই সবুর সাহেব হয়তাে ভুলে যেতে চেয়েছেন যে, পল্টন ময়দানে দাড়িয়ে যে নূরুল আমীন সরকারের তিনি নিন্দা করে গেলেন, সেদিন তিনি নিজেই ছিলেন সে দলের প্রচার-সম্পাদক। আর গভর্নর মােনেম ছিলেন তাদের ময়মনসিংহ জেলার ‘কনর্ধার’ । ১৯৪৭ সাল থেকে ‘৫৪ সাল পর্যন্ত তাদের দল মুসলিম লীগই ক্ষমতায় ছিল। এই দীর্ঘ ৮ বছর পর্যন্ত দেশবাসীর উপর যে অত্যাচার-অনাচার চালান হয়েছিল, সবুর সাহেব। কস্মিনকালেও তার প্রতিবাদ করেছিলেন কি? না তিনি মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে তার প্রশস্তিই গেয়ে গিয়েছিলেন?
১৯৫৫ সালের আওয়ামী লীগ
সবুর সাহেব আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত প্রচারই করুন না কেন, খাতাপত্রে, জাতীয় পরিষদের প্রসিডিং বই-এর পাতায় পাতায় এই সত্যেরই প্রমাণ মিলবে যে, জনাব সবুর ও তাঁর মুরুব্বীর দল আজ যে বৈষম্যের কথা তুলে নিজেদের ফেরেশতা সাজাতে চাইছেন, সেই বৈষম্যের কথা জনাব সবুরের মুরুব্বীরা এই সেদিন পর্যন্তও স্বীকার করতে না চাইলেও ১৯৫৫ সালে মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে আওয়ামী লীগই সর্বপ্রথম চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করা হয়েছে। কিভাবে তাকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
কায়েমী স্বার্থীদের আঁতে ঘা
আজ সবুর সাহেবরা বড় গলায় যত কথাই বলুন না কেন, একথা কারও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একমাত্র আওয়ামী লীগই কেন্দ্রীয় সরকারের বরাবরের এক-চোখাে নীতি ধরে দিয়েছিলেন এবং মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে অন্য দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে সর্বপ্রথম এই বৈষম্য রােধের চেষ্টা পেয়েছিলেন। সেদিনের সে আওয়ামী কোয়ালিশনের এই বৈষম্যরােধী প্রচেষ্টার কায়েমী স্বার্থী মহলের আঁতে ঘা লাগে। তাই, ‘প্যালেস-ক্লিকের টানাপােড়েন সােহরাওয়ার্দী-সরকারকে ক্ষমতার আসন। থেকে নেমে আসতে বাধ্য করে।
তাই, সবুর সাহেবদের উদ্দেশে একথা আমি জোর গলায় ঘােষণা করতে চাই যে, আওয়ামী লীগ আর যা-ই করুক, পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বাস-ঘাতকতা তারা কোন কালে করেনি। আর করেনি বলেই জেল-জুলুম আর অত্যাচারনির্যাতন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের নিত্য সহচরে পরিণত হয়েছে।
আওয়ামী লীগকে রােখাে!
১৯৫৮ সালের ইতিহাস বড় করুণ, বড় নির্মম। আওয়ামী লীগ তখন প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিল না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ১৫টি উপনির্বাচনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪টি আসন দখল করে। ফলে, উপর তলার কুচক্রী মহলে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল চিন্তা করে আতঙ্কের সঞ্চার হয়। সােহরাওয়ার্দী সরকারের ১৩ মাসের শাসনে এম্নিতেই তাদের নাভিঃশ্বাস উঠেছিল। এবার তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠল কি করে আওয়ামী লীগকে রােখা যাবে। উপর তলার দুর্নীতিপরায়ণ অফিসার মহলও প্রমাদ গণলেন। তাঁরা বােঝাতে লাগলেন, সাধারণ নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগকে আর রােখা যাবে না, আর তারা যদি একবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তবে আর নিস্তার নেই। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বঞ্চনার মাসুল তারা কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে নিবে। পশ্চিম পাকিস্তানের শতকরা ৩০টা কারখানা বাজারের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই পূর্ব পাকিস্তানীদের চোখ বন্ধ করার জন্য নির্বাচনের প্রতিশ্রুত তারিখের মাত্র ৪ মাস আগে দেশে মার্শাল ল জারি করা হলাে। সারা দেশে ৪ হাজার রাজনীতিক ও কর্মীকে বন্দী করা হলাে। এদেশের মানুষ সবই দেখল কিন্তু আন্দোলন করতে সাহস পেল না। দেশবাসীর এই নির্জীব অবস্থার সুযােগ নিয়ে প্রতিপক্ষের স্পর্ধা আরও বেড়ে গেল। একের পর এক দেশবাসীর অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সারা দেশে কবরের শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হল।
করাচী থেকে রাজধানীও আজ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সবুর সাহেব দর্পভরে এলান করে গিয়েছেন যে, করাচীর জন্য পূর্ব পাকিস্তানের একটি পয়সাও ব্যয় করা হয়নি। আমি বলি, তিনি মিথ্যা চর্চা করেছেন। সে কয়বছরে পূর্ব পাকিস্তান যে ১২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছিল, তার সিংহভাগই করাচীকে গড়ে তােলার কাজে ব্যয় করা হয়েছিল, একথা অস্বীকারের কোন উপায় নেই।
কে না জানে যে, দেশরক্ষা ও কেন্দ্রীয় চাকুরীতে গােটা দেশের বাজেটের শতকরা ৮০ ভাগ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রে স্বাধীনতা লাভের ১৭ বছর পরেও আজও কোথাও শতকরা ১০ জনের বেশী বাঙ্গালী নেই।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ৫টি স্তম্ভ ও পূর্ব পাকিস্তান
মােটামুটি ৫টি স্তম্ভের উপর যে-কোন দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম থাকে, যথাঃ কেন্দ্রীয় সরকার, রাজধানী, প্রতিরক্ষা, মূলধন ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বা পার্লামেন্ট। আজাদী অর্জনের পর থেকে এর প্রথম চারটি স্তম্ভ কোনকালেই পূর্ব পাকিস্তানীদের নাগালে ছিল না। ছিল কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এই রাজনৈতিক ক্ষমতার যথাসম্ভব সদ্ব্যবহারের যে সুযােগটুকু আমাদের ছিল, তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে। পার্লামেন্টের হাতে আজ আর কোন ক্ষমতাই নেই। কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গেয়ে আসা ছাড়া পার্লামেন্ট সদস্যদের আজ আর অন্য কোন কাজ নেই। মূলধনের কথা না বলাই ভাল। মাত্র ২০০টি ভাগ্যবান পরিবারের হাতে আজ এদেশের পুঁজি।
ভেল্কি!
সামরিক শাসন জারি করে দেশকে যে ভেল্কি দেখান হল সে এক ইতিহাস। ৭ই অক্টোবর যিনি প্রধান সামরিক শাসনকর্তা, ২৭শে অক্টোবর তিনি প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট তাঁকে করল কে? তিনি নিজেই। তারপর গড়লেন তিনি মৌলিক গণতন্ত্রী, এরা কারা তাঁর বশংবদ। তারপর করলেন কি?- আস্থা ভােট! প্রার্থী কে কে? তিনি একেলা। ভােটের ফলাফল যাচাইর ব্যবস্থা কি ?- ‘হ্যাঁ’ হলেও আমি ‘না’ হলেও আমি।
তারপর বললেন, এবার আমি দেশকে এমন একটা শাসনতন্ত্র দেব যা দুনিয়ার কেউ কখনও দেখেনি। তার কথাই ঠিক- সত্যিই দুনিয়ায় এমন শাসনতন্ত্র কেউ কখনাে দেখেনি।
বাংলা দেশের মানুষ সােডা ওয়াটারের বােতল
আপনারা বাংলা দেশের মানুষ সােডা ওয়াটারের বােতল, তাই অল্প পরেই সব কিছু ভুলে যান। এদেশের ছাত্রদের ইতিহাস, শ্রমিকদের ইতিহাস, শিক্ষকদের ইতিহাস আপনারা শুনেছেন। জানেনও। পশ্চিম পাকিস্তানে মাধ্যমিক শিক্ষার ভার সরকার স্বহস্তে নিয়েছেন, আর পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষকরা আজও বাঁচার মত বেতন-দাবীতে ধর্মঘট করতে যান।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কর!
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবন্ধুরাও কম যান না। গভর্নর মােনেম যাবেন চ্যান্সেলর হিসাবে সমাবর্তনে বক্তৃতা করতে। ছাত্ররা বলল, সমাবর্তন উৎসবে শিক্ষাবিদের বক্তৃতা শুনব- রাজনীতিকের নয়। গভর্নর বললেন, আমার বক্তৃতাই শুনতে হবে। ছাত্ররা বিগড়ে বসলাে। গভর্নর সাহেব সমাবর্তন মণ্ডবে পা দিলেন, দেখলেন, চেয়ার, টেবিল, ফুলের টব সবই বিধ্বস্ত, লণ্ডভণ্ড। তবু যে কথা সেই কাজ। বিধ্বস্ত সমাবর্তন মণ্ডপে, টিয়ারগ্যাস শেল ছোড়ার শব্দ। আর ছাত্রদের বিক্ষোভ ধ্বনির মধ্যে বক্তৃতা করে কঠোর পুলিশ প্রহরায়। ‘সগর্বে তিনি বেরিয়ে এলেন। এসেই হুকুম দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কর, হল বন্ধ কর, ছাত্রদের তাড়াও। বশংবদের দল তৎপর হল। এক ঘণ্টার মধ্যে ইকবাল হলের তিনশতাধিক ছাত্র রমনা থানার হাজতে স্থান পেল। ৭ দিন পর সেখান থেকে জেলে।
নাবালক ছেলে ক’টির অপরাধ কি?
আমার বিরুদ্ধে এখনাে ৩টা মামলা আছে, তার কারণ না হয় বুঝি। কিন্তু ছাগলনাইয়ার ৭টি নাবালক স্কুলছাত্র কি অপরাধ করেছিল যার জন্য দুইমাস পর্যন্ত তাদের হাজতে আটকে রাখা হল ? হাইকোর্ট জামিন না দেয়া পর্যন্ত দুইমাস যাবৎ তাদের জামিন দেয়া হয়নি। নাবালক স্কুলছাত্রদের এই ভাবে শাস্তি দেয়ার, হয়রানি করার নজীর কোনও সভ্যদেশের ইতিহাসে নেই।
তেলা মাথায় তেল!
পে কমিশনের রিপাের্ট দিবালােকের মুখ দেখল না। তবু, তারই রােয়েদাদ অনুযায়ী নাকি সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়ানাে হয়েছে। বাড়ান হয়েছে ঠিকই, তবে উপরতলায়। আদতে গরীব কর্মচারীদের বেতন কিছুই বাড়েনি। ২০ টাকার বেতনের কর্মচারীর ৫ টাকা বেড়েছে কিন্তু ২০০০ বেতনের কর্মচারীর বেতন বাড়িয়ে ৩০০০ টাকা করা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করি, এই কি তােমাদের বিচার ? নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির দরুন ২০০০ টাকার কর্মচারীর জীবনে আদৌ কি কোনও বিপর্যয় ঘটেছিল ? ২০ টাকার কর্মচারীর জীবনে যে বিপর্যয় ঘটেছে তার প্রতিবিধান কি ৫/৭ টাকা বেতন বৃদ্ধিতেই সম্ভব ? তেলা মাথায় তেল না দিয়ে এদেশের গরীব কর্মচারীদের বেতন ন্যায়সঙ্গত পরিমাণে বাড়ান কি একেবারেই অসম্ভব ছিল ?
আইয়ুব সরকারের কমিশন!
গুরুতর কোন সমস্যা খতিয়ে দেখে তার প্রতিবিধানের পথ নির্দেশের জন্যই দেশে দেশে কমিশন গঠন করা হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কত কমিশনই না নিয়ােগ করলেন। কিন্তু তার রিপাের্টের হল কি? পে কমিশন, ভােটাধিকার কমিশন, শাসনতন্ত্র কমিশন- কোনটির রিপাের্টই তিনি গ্রহণ করেননি। বেছে বেছে নিজ পছন্দ মত বিচক্ষণ লােক দিয়ে যে কমিশন তিনি গঠন করলেন, তাঁদের সুপারিশ যদি তিনি গ্রহণই না করেন, তাহলে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে লােকদেখানাে এ কমিশন গঠনের অর্থ কী? এমনকি খাস করে সরকারী অফিসারদের নিয়ে যে অর্থনৈতিক কমিশন গঠন করা হয়, তার রিপাের্টিও গােপন করা হয়েছে। রিপাের্টটিতে পূর্ব পাকিস্তানকে কিভাবে শােষণ করা হয়েছে তার বিবরণ স্থান পেয়েছিল বলেই কি তা গােপন করা হয়নি?
এদেশের কৃষককুল বনাম সরকার
এদেশের কৃষককুল আজ ধ্বংসের মুখে। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা দাবী করেছিলাম ২৫ বিঘা পর্যন্ত যাদের জমি আছে, অন্ততঃ ১০ বছরের জন্য তাদের খাজনা মওকুফ করা হােক। তাতে ক্ষমতাসীনরা হেসেছেন। সরকারী রিপাের্টের খোঁজ রাখা হয়তাে তারা প্রয়ােজন মনে করেন না। আমাদের কথা নয়, সরকারী রিপাের্টেই বলা হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকরা ৯৩ কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত। যে কৃষককুল দেশের সর্বোচ্চ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার কথা চিন্তা করার অবসর সরকারের নেই। ৯৩ কোটি টাকার এ ঋণ শােধ দেয়াতাে দূরের কথা, চক্রবৃদ্ধিহারে বৃদ্ধি পেতে পেতে অদূর ভবিষ্যতে তা যে তার সমগ্র সত্তাকেই গ্রাস করতে চলেছে, একথাও ভেবে দেখার সময় সরকারের নেই। জানি সরকারের সময় অত্যন্ত মূল্যবান। তবু দেশের স্বার্থে কৃষককুলকে বাঁচাবার জন্য খাজনা মওকুফ করা একান্ত অপরিহার্য। রাজস্ব ঘাটতির অমূলক আশঙ্কায় সরকার এ প্রস্তাবে সম্মত হতে নারাজ। অথচ, কোটিপতি শিল্প মালিকদের ১০ বছরের জন্য ট্যাক্স মওকুফের বেলায় তারা দারাজ দিল। শিল্প ব্যাঙ্ক থেকে যে ভাগ্যবানের দল শতকরা ৭৫ ভাগ ঋণ পেয়ে রাতারাতি ধনকুবের বনে মুনাফার পাহাড় গড়েছেন। তাদেরকে ট্যাক্স থেকে অব্যাহতি দিয়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী, ঋণভারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এদেশের ভুখা-নাঙা কৃষককুলকে খাজনা থেকে অন্ততঃ কয়েকটি বছরের জন্য অব্যাহতি দিলে নিশ্চয়ই আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়ত না। ওয়ার্কস প্রােগ্রামের নামে বিনা হিসাবে বিনা অডিটে বছরে বছরে ২০/২৫ কোটি টাকা অনুৎপাদনধর্মী কাজে ব্যয় করে যে ফায়দা না উঠান যাচ্ছে, ৭ থেকে ৮ কোটি টাকার খাজনা মওকুফ করলে তার চেয়ে অনেক বেশী ফায়দা উঠান যেত, কৃষককুলকেও কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করা সম্ভব হত।
আওয়ামী লীগ হাল্কা শ্লোগান দেয় না
ওঁরা বলেন, আওয়ামী লীগ হাল্কা শ্লোগানে লােক ভুলায়। জবাবে আমি বলব, আওয়ামী লীগ হাল্কা শ্লোগান দেয় না। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসী মানুষের অভাব-অনটন, অনাহার-অনশনের যে চিত্র আমরা দেখেছি, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে আমরা আমাদের দাবী তুলেছি। সােনার বাংলা আজ শ্মশানে পরিণত। একদিন ছিল যখন কবি, জারি, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়ার সুরে এই বাংলার পথ-প্রান্তর, মাঠ-ঘাট ও নদীগুলি মুখরিত হয়ে থাকত, আজ সে সুরের শেষ রেশটুকুও মুছে গেছে। পল্লীবাংলা আজ ভুখানাঙা। আর তারই যােগানাে অর্থে আজ পিণ্ডিতে নয়া রাজধানী গড়ে উঠছে।
আওয়ামী লীগ গণ-আন্দোলনে বিশ্বাসী
আওয়ামী লীগ গণ-আন্দোলনে বিশ্বাসী। জেল-জুলুমের তারা তােয়াক্কা করে না। জনসাধারণের দাবী আদায়ের সংগ্রামে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করবেন। এমন নির্ভীক সংগ্রামশীল যেকোন রাজনৈতিক দলের সাথে জাতীয় সমস্যার সমাধানে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সংগ্রামে হাত মিলিয়ে কাজ করতে আওয়ামী লীগ সর্বদাই প্রস্তুত। যে সব রাজনীতিক রাষ্টীয় সমস্যা নিয়ে আয়েশী রাজনীতি করেন বা জনসাধারণের দাবী নিয়ে আলাপ-আলােচনা বা দরকষাকষির মাধ্যমে আন্দোলন সংক্ষেপ করার পক্ষপাতী, আওয়ামী লীগ তাদের এখন দূরে থাকার পরামর্শ দেয়। জেল-জুলুমের ধকল সয়ে এ দেশের নির্যাতিত জনতা যদি কোনদিন তাদের সংগ্রামে জয়ী হয়, তখন এই সব রাজনীতিককে আমরা হাসিমুখে বরণ করে নেব। কেউ যেন মনে না করেন যে, আমি জনগণকে আওয়ামী লীগে যােগদানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে পেতে হলে দেশবাসীর স্বার্থ নিয়ে সংগ্রাম করে এমন অথবা আওয়ামী লীগের চেয়ে অধিকতর ত্যাগী কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকলে সেই প্রতিষ্ঠানে আপনারা যােগদান করুন ; আমরা বিন্দুমাত্র দুঃখিত হব না। কারণ, আমরা চাই, দেশবাসী তাদের হৃত অধিকার ফিরে পাক সে যে দলে থেকেই হােক। স্মরণ রাখবেন, আসন্ন নির্বাচনে বিরােধীদল জয়লাভ করলেই বর্তমান শাসকগােষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না ; কারণ এ সরকারের পিছনে দেশবাসীর সমর্থন না থাকলেও অন্য ধরনের ক্ষমতাবান শ্রেণীর সমর্থন আছে। আজকের এ সগ্রামকে আওয়ামী লীগ সর্বাত্মক সংগ্রাম বলেই জানে। এবং তারা বিশ্বাস করে যে, এই আন্দোলনে জয়ী হতে হলে দেশবাসীকে চরম ঝুঁকি লওয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব