ইত্তেফাক
২১শে জুন ১৯৬৪
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পদে পদে বঞ্চনা
ময়মনসিংহ ও গৌরীপুরের জনসভায়
শেখ মুজিবের বক্তৃতা
(ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি)
ময়মনসিংহ, ১৮ই জুন- অদ্য এখানে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, (অংশ বিশেষ গত বৃহস্পতিবারের ইত্তেফাকে প্রকাশিত হইয়াছে) মরহুম শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বাঙ্গালীরাই পাকিস্তানের প্রকৃত স্রষ্টা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বাঙ্গালীদিগকে বর্তমানে সকল জাতীয় হিস্যা হইতে বঞ্চিত করা হইতেছে এবং তাহাদের ধনসম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক উন্নয়নে সদ্ব্যবহার করা হইতেছে। বাঙ্গালীদের টাকায় করাচী নগরী নির্মাণের পর কর্তৃপক্ষ এখন ইসলামাবাদ নগরী নির্মাণ করিতেছেন।
অতীতে দেশে সামরিক আইন জারির কারণ বর্ণনা করিয়া তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানকে ভােটাধিকার হইতে বঞ্চিত করার জন্য উহা একটি ষড়যন্ত্র ছিল। ইহার উদ্দেশ্য ছিল এমন সব প্রতিনিধি নির্বাচন করা- যাহারা পূর্ব পাকিস্তানের অধিকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইবেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ৫টি স্তম্ভ যথা রাজধানী, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, মূলধন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান কখনও রাজধানীর সুযােগ-সুবিধা ভােগ করিতে পারে নাই।
ইতিপূর্বে করাচীতে রাজধানী ছিল, বর্তমানে রাওয়ালপিণ্ডিতে। প্রধানতঃ পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় করাচী নির্মাণ করা হইলেও পূর্ব পাকিস্তানের কোন মতামত না নিয়াই উহা পশ্চিম পাকিস্তানের নিকট হস্তান্তর করা হইয়াছে। তিনি আরও বলেন যে, রাজধানী শহর পশ্চিম পাকিস্তানে থাকার ফলে সেখানেই পুঁজি গঠন চলিতেছে। এজন্যই পাকিস্তানের শতকরা ৮০ ভাগ সম্পদ আজ প্রায় ২ শত পরিবারের করায়ত্ত। তবে ইহাদের মধ্যে একজনও পূর্ব পাকিস্তানী নহেন।
তিনি বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত থাকায় উহার শতকরা মাত্র ১০ ভাগ কর্মচারী পূর্ব পাকিস্তানী। পূর্ব পাকিস্তান ইতিপূর্বে শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী থাকিলেও উহাও কাড়িয়া নেওয়া হইয়াছে।
মওলানা তর্কবাগীশ
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা তর্কবাগীশ মাথাভারী শাসন ব্যবস্থার সমালােচনা করিয়া বলেন যে, সরকার গরীব স্কুল শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির করিতে না পারিলেও পদস্থ সরকারী অফিসারদের বেতন বৃদ্ধি করিয়াছেন। মেসার্স খােন্দকার মােশতাক আহমদ, রফিক উদ্দীন ভূঁইয়া প্রমুখও সভায় বক্তৃতা করেন।
গৌরীপুরের জনসভায় বক্তৃতা
গতকল্য গৌরীপুর বাজারে আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেন, দেশের গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে এবং পল্লী গ্রামের জনসাধারণ এক বিরাট দুর্দশার মধ্যে কালযাপন করিতেছে। পল্লী গ্রামের জনসাধারণ উৎপাদিত শস্যের ন্যায্যমূল্য পাইতেছে না, অথচ তাহাদের উপর অত্যধিক করের বােঝা চাপান হইয়াছে। এই দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকরাই বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ যােগাইয়া থাকে। রাজধানী স্থানান্তরের পর করাচীকে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার তীব্র নিন্দা করিয়া শেখ মুজিব বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় নির্মিত করাচী নগরী পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করিয়া সরকার পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়াছেন। সরকারের এই নীতির ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেন, যদি রাজধানী স্থানান্তর করিতেই হয় তবে উহা করাচী হইতে ঢাকায় স্থানান্তর করিতে হইবে। শেখ মুজিব বলেন, অতীতের জনপ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযােগ করা হইয়াছিল, বর্তমান সরকারের আমলে তাহা বহুগুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। সভায় বক্তৃতা করেন জনাব আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, জনাব হাসেম আলী তালুকদার, জনাব শামসুল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম (এডভােকেট), জনাব রফিক উদ্দীন ভূঁইয়া। সভায় সভাপতিত্ব করেন ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি জনাব জুলমত আলী খান।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব