ইত্তেফাক
২৫শে মে ১৯৬৪
চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করার আহ্বান
ভৈরবের বিরাট জনসভায় শেখ মুজিবরের বক্তৃতা
(ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি প্রেরিত)
ভৈরব, ২৪শে মে- অদ্য ভৈরব বাজার দক্ষিণ পট্টিতে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দেন যে, আরবী হরফে বাংলা লেখার ধুয়া তুলিয়া পূর্ব পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান বাসীদের জন্মগত অধিকারের বিরুদ্ধে আবার তৎপরতা শুরু করা হইয়াছে। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের আশা-আকাংক্ষা বাস্তবায়নের একমাত্র হাতিয়ার রাজনৈতিক অধিকার হরণ করিয়াই স্বার্থান্বেষী মহল ক্ষান্ত হয় নাই, এক্ষণে একটি স্থীরিকৃত সত্যকেও তাহারা বানচাল করার প্রয়াসে মাতিয়াছে। দেশবাসীকে সংহতভাবে সংগঠিত হইবার আহ্বান জানাইয়া শেখ মুজিব বলেন যে, চতুর্দিকে আজ চক্রান্তের বেড়াজাল এমনভাবে বিস্তার করা হইয়াছে যে, অবিলম্বে এই সবের বিরুদ্ধে না দাঁড়াইলে পূর্ব পাকিস্তানীদের অস্তিত্ব বিপন্ন হইয়া উঠিবে।
শেখ মুজিব ঘােষণা করেন যে, প্রবল পরাক্রমশালী মুসলিম লীগের ভ্রুকুটি, অত্যাচার ও নির্যাতনকে উপেক্ষা করিয়া ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ যেভাবে দেশবাসীর স্বার্থ লইয়া অসম সাহসে সংগ্রামে অবতীর্ণ হইয়াছিল, আজও তেমনি অকুণ্ঠ চিত্তে ও অসম সাহসে সাহসী হইয়া আওয়ামী লীগ দেশবাসী ও দেশের স্বার্থ রক্ষার্থ কুচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর সগ্রামের শপথ লইয়া কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছে। মুহুর্মুহু জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে শেখ সাহেব দেশবাসীকে ‘স্বদেশী দালালদের চিনিয়া রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান দুর্দশার জন্য ‘পরের ছেলেকে অভিশাপ দিয়া লাভ নাই আমাদেরই ঘরের একশ্রেণীর দালাল দেশের স্বার্থ বলি দিয়া নিজেদের স্বার্থের খাতিরে আজ দেশের সর্বনাশ করিয়া চলিয়াছে। তিনি বলেন যে, এই দালাল শ্রেণীর নাম আজ স্থায়ী খাতায় লিখিয়া রাখিতে হইবে এবং যখন সময় আসিবে, তখন জনতার আদালতে ইহাদের এমন বিচার করিতে হইবে যাহাতে জীবনের তরে তাহারা আর দ্বিতীয়বার বিশ্বাসঘাতকতার সুযােগ না পায়।
ভােটাধিকার প্রশ্নে শেখ মুজিব বলেন যে, দেশবাসীকে ভােটাধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া বর্তমান শাসক গােষ্ঠী জাতির কপালে যে অবিশ্বাসের তিলক আঁকিয়া দিয়াছেন, সেই গ্লানি মুছিবার জন্য আজ দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্বার সংগ্রাম শুরু করিতে হইবে। তিনি দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দেন যে, আজ সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্য এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়াছে যে, ইউনিয়ন কাউন্সিলের অনেক চেয়ারম্যানই কর্তা ব্যক্তিদের কাছে তার করিয়া জানাইয়া দিয়াছেন যে, এ দেশবাসী মূর্খ এবং এই দেশবাসী প্রত্যক্ষ ও প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার চায় না। তিনি ঘােষণা করেন যে, এই সকল চেয়ারম্যানের তালিকা প্রস্তুত করা হইয়াছে এবং আগামী নির্বাচনের পূর্বেই এই তালিকা ছাপাইয়া সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রেরণ করা হইবে।
ভৈরবের এই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। খােন্দকার মােশতাক আহমদ, অধ্যাপক হাফিজ হাবিবুর রহমান, সাবেক এম, পি, এ জনাব সিরাজুল হক, জনাব জিল্লুর রহমান, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, সাবেক এম, পি, এ জনাব আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া এবং ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সভায় বক্তৃতা করেন। সভার প্রারম্ভে কোরান তেলাওয়াতের পর মরহুম শহীদ সােহরাওয়ার্দীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করিয়া মােনাজাত করা হয়। অদ্য (সােমবার) প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিবেন। (অসমাপ্ত)
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব