ইত্তেফাক
৩১শে মে ১৯৬৪
ওয়ার্কস প্রােগ্রামের অর্থ শিল্প স্থাপনে ব্যয়ের আহ্বান
চাঁদপুরের জনসভায় শেখ মুজিব কর্তৃক সরকারী অপব্যয়ের কঠোর নিন্দা
(ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি)
গত শুক্রবার চাঁদপুরের আজিজ আহমদ ময়দানে চাঁদপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়ােজিত এক অভূতপূর্ব জনসমাবেশে বক্তৃতাকালে (আংশিক বিবরণ গত শনিবারের ইত্তেফাকে প্রকাশিত হইয়াছে) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেন যে, ১৯৫৯ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসিত এবং ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে আর বঞ্চিত করা সম্ভব হইত না- এই আশংকায় শিল্পপতি, এক শ্রেণীর সরকারী মহল এবং কুচক্রীরা চক্রান্ত করিয়া দেশে সামরিক শাসন জারি করার ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন যে, ডেপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলীর মৃত্যুকেই সামরিক শাসন জারির কারণ বলিয়া অনেকেই উল্লেখ করেন। কিন্তু সামরিক শাসনামলে কেন এই হত্যাকাণ্ড সংগঠকদের বিচার করা হইল না শেখ মুজিব তাহা জানিতে চাহেন। তিনি আরও বলেন যে, সামরিক বাহিনীর সদর দফতর রাওয়ালপিণ্ডিতে জনাব লিয়াকৎ আলী খান নিহত হন, তখন তাে দেশে সামরিক শাসন জারি হয় নাই। শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, বিপ্লবের অধিনায়করা ‘বিপ্লবের পরে বলিতে থাকেন যে, দেশে দুর্নীতি বাড়িয়া গিয়াছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিকরা দেশের অশেষ ক্ষতি করিতেছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে দেশে দুর্নীতি পূর্বের অপেক্ষা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং ট্যাক্স বাড়িয়াছে বহুগুণ। তিনি আরও বলেন যে, যে রাজনীতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সর্বাধিক বিষােদগার করা হইত এক্ষণে ক্ষমতাসীনরা সেই রাজনৈতিক দল গঠন করিয়া ও রাজনীতিক বনিয়া রাষ্ট্র চালাইতেছেন।
বর্তমান শাসনতন্ত্রের স্বরূপ উদ্যাপন প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেনঃ বর্তমান শাসনতন্ত্রে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত করা হইয়াছে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কোনই ক্ষমতা নাই। এমনকি জনগণের প্রদত্ত অর্থের আয়-ব্যয়ের হিসাব অর্থাৎ বাজেটের ব্যাপারে ভােট দিবার অধিকারও পরিষদে নাই। মন্ত্রীদের কোন ক্ষমতা নাই এবং তাহাদের অস্তিত্বের কোন ঠিক-ঠিকানা নাই। যে কোন সময় বিনা কৈফিয়তে তাহাদের চাকরি হরণ করা যাইতে পারে।
জনগণের মুহুর্মুহু ‘সােহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ এবং ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেনঃ পূর্ব পাকিস্তানের কৃষককুল আজ চরম সংকটের সম্মুখীন হইয়া পড়িয়াছে। করভারে তাহারা জর্জরিত। তাই যাহারা ২৫ বিঘার কম জমির মালিক তাহাদের খাজনা আগামী ২৫ বৎসরের জন্য মওকুফ করিতে হইবে। নতুবা এই কৃষককুলের শেষ রক্ষার কোনই উপায় থাকিবে না। শেখ মুজিব আরও ঘােষণা করেন যে, সরকার যদি অবিলম্বে এই ন্যায্য দাবী মানিয়া না লন। তাহা হইলে এই দাবী আদায়কল্পে আওয়ামী লীগ প্রদেশব্যাপী এক ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু করিবে। তিনি উল্লেখ করেন যে, দেশে কোন নূতন শিল্প। প্রতিষ্ঠিত হইলে প্রতিষ্ঠার পরে প্রথম ৫ বৎসরের কর মওকুফ করা হয়; অতএব কৃষিজীবীদের কর কেন মওকুফ করা হইবে না।
ওয়ার্কাস প্রােগ্রামের কঠোর সমালােচনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, ওয়াকার্স প্রােগ্রামের নামে বিপুল অর্থ ব্যয় করিয়া যেসব কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করা হইতেছে, সেগুলির অধিকাংশই বর্ষাকালে নষ্ট হইয়া যাইবে। তিনি বলেন যে, এই অর্থ দ্বারা যদি প্রদেশে ভারী শিল্প স্থাপন করা হইত তাহা হইলে এই প্রদেশের বেকার যুবকেরা চাকুরী পাইয়া জীবিকা নির্বাহ করিতে পারিত। তিনি আরও বলেন যে, বহু গ্রামে ওয়ার্কস প্রােগ্রামের জন্য কোনরূপ ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকেই জমি দখল করা হইয়াছে।
শেখ মুজিবর রহমান জনগণের প্রতি আহ্বান জানাইয়া বলেনঃ সংঘবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে সগ্রামের জন্য সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজন। মরহুম সােহরাওয়ার্দীর আত্মা বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে আর্তনাদ করিয়া ফিরিতেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপনাদিগকে অবশ্যই রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। মরহুমের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়া আমাদিগকেও আত্মত্যাগ করিতে হইবে। ছাত্রদের উপর নির্যাতন, গ্রেফতার এবং রাষ্ট্রিকেশনের প্রতিবাদ করিয়া বক্তৃতা দানকালে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, ছাত্ররা কঠোর সাধনা করিয়া যে এম, এ, ডিগ্রী লাভ করে উহা প্রত্যাহার করা যাইতে পারে- এমন নজির দুনিয়ার কোথাও নাই।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব