বাংলার বাণী
ঢাকা : ২০শে মার্চ, বুধবার, ১৯৭৪, ৬ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বাংলাদেশ-পোল্যান্ড যুক্ত ইশতেহার
পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর শেষে গতকাল প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে এবং পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের দাবী জানানো হয়। বস্তুতঃ পোল্যান্ড ও বাংলাদেশ বিশ্বশান্তির স্বপক্ষে সব সময়ই অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় কাজ করে আসছে। বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি স্বরূপ। কেননা বৃহৎ শক্তিবর্গের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বিশ্বের উন্নয়নশীল ও ক্ষুদ্র দেশগুলোর প্রতি একদিকে যেমন সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে তেমনি তাদের উন্নয়নও ব্যাহত করছে। সে কথাটাই এতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
পোল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব পারস্পরিক সম্মান, সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে। সেই সম্পর্ক একটি দৃঢ়তর সম্পর্ক। মৈত্রী বন্ধনে এ দু’টি দেশ অটুট। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ স্টিফেন ওলজোস্কীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের ফলে সেই সম্পর্ক আরো জোরদার হবে—দৃঢ়তর হবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মিঃ ওলজোস্কী গত রোববার ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে তারই প্রতিধ্বনি করেছেন।
তিনি বলেছেন, তাঁর দেশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবে। অবশ্য এই অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রক্রিয়া পরে নির্ধারণ করা হবে এবং এ জন্য একটি পোলিশ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনও গঠন করা হবে। এই কমিশন প্রধানতঃ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই কাজ করবে। এই অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতা দানের এক পর্যায়ে পোল্যান্ড বাংলাদেশকে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহযোগিতা সহ ৫০ লাখ স্টার্লিং পাউন্ড ঋণ দেবে। তাছাড়া বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ, স্পিনিং মিল এবং সিলেট ও তার আশেপাশের এলাকায় বৈদ্যুতিকরণের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাহায্য করতেও প্রস্তুত রয়েছে। পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কাপ্তাইয়ের কাঠ কারখানার যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা বদলে দিতে পোল্যান্ড আগ্রহী। এছাড়াও তাঁর দেশে চামড়া, কাঠ, মাছ ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণের ব্যাপারেও সাহায্য দিতে পারে। পোল্যান্ড ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে যে ঋণদানের অঙ্গীকার করেছে, তা দিয়েই এই প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে তিনদিনব্যাপী সফরকালে পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনের সাথে দ্বি-পাক্ষিক বিষয়ে যে সব মতবিনিময় করেছেন ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে যে সব আলাপ-আলোচনা করেছেন তা অত্যন্ত সন্তোষজক হয়েছে এবং এ সব ব্যাপারে তাঁরা ঐক্যমত্যে উপনীত হতে পেরেছেন বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মিঃ ওলজোস্কী উল্লেখ করেন যে, পোল্যান্ড ও বাংলাদেশ শান্তি, অগ্রগতি ও স্বাধীনতার স্বার্থের প্রতি প্রতিশ্রুত। পোল্যান্ড বাংলাদেশের জাতিসংঘ অন্তর্ভুক্তি প্রশ্নে সোচ্চার। কেননা, এই দেশ মনে করে যে, বাংলাদেশের জাতিসংঘের বাইরে অবস্থান এই বিশ্বসংস্থার বিশ্বজনীনতা বিঘ্নিত করছে। তিনি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পারস্পরিক স্বীকৃতি এই উপমহাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলেও অভিহিত করে এটাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় বলে মন্তব্য করেন।
পূর্ব ইউরোপীয় অন্যতম সমাজতান্ত্রিক দেশ পোল্যান্ড বাংলাদেশের বিপদকালীন সময়ের অন্যতম একটি পরীক্ষিত বন্ধু দেশ। জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে পোল্যান্ড ও বাংলাদেশ একই ঐতিহ্যের অধিকারী। উভয় দেশের সরকার ও জনগণ সংগ্রামের সুমহান ঐতিহ্যে ভরপুর। তাই পোল্যান্ডের জনগণ ও বাংলাদেশের জনগণ একে অপরকে হৃদয়ের কাছাকাছি বলে ভারতে পারে। তারই সূত্র ধরে রচিত হয়েছে এই দু’টি দেশের মধ্যকার মৈত্রীত্বের বন্ধন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে এক ফ্যাসিস্ট শক্তির আক্রমণে বিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত হয়েছিল শান্তিকামী মানুষের দেশ পোল্যান্ড। তেমনি বিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত হয়েছে একাত্তর সালে আরেক ফ্যাসিস্ট পশুশক্তির হামলায় শান্তিকামী বাঙালীর দেশ বাংলাদেশ। সেদিন যেমন পোল্যান্ডের সার্বিক উন্নয়নে, বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনঃজাগ্রত করার প্রয়োজনে বিশ্বের আর শান্তিকামী ও বন্ধু মনোভাবাপন্ন দেশ এগিয়ে এসেছিল পোল্যান্ডের পাশে দাঁড়াতে এবং পোল্যান্ডের জনগণও তাঁদের মহান নেতাদের নেতৃত্বে ব্রতী হয়েছিলেন কঠোর জীবন সংগ্রামে—ঠিক তেমনিভাবে একাত্তরের ফ্যাসিস্ট হামলাকালে ও তার পরবর্তী পর্যায়ে বিধ্বস্ত দেশ ও পর্যুদস্ত অর্থনীতিসম্পন্ন বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে এবং অর্থনৈতিক জীবনে পুনঃজাগরণ আনার জন্য এদেশের পাশে যে শান্তি ও সহযোগিতাকামী দেশগুলো এগিয়ে এসেছে পোল্যান্ড তার মধ্যে অন্যতম। এখন এদেশের মানুষের একমাত্র করণীয় মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও নেতৃত্বে নিজেদের ও নিজেদের ভবিষ্যত বংশধরদের জীবন ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও জীবনের সর্বস্তরে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর জীবন সংগ্রামে ব্রতী হওয়া।
আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি উন্নয়নে পোল্যান্ড যে সাহায্যদান করছে তা এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ-পোল্যান্ড মৈত্রী দীর্ঘস্থায়ী হোক।
লোকান্তরে বুদ্ধদেব বসু
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বুদ্ধদেব বসু আর নেই। গত রোববার রাতে পয়ষট্টি বছর বয়সে কলকাতার বুদ্ধদেব বসুর মহাপ্রয়াণ ঘটে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে হাসপাতালের শয্যায় তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যু সংবাদ ছিল আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। কারণ, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সেবায় নিয়োজিত এক নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যে এক শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। এই আকস্মিক ঘটনার জন্যে আমরা কেউ-ই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু মৃত্যুকে তো আর ধরে রাখা যায় না। মৃত্যু তার আপন নিয়মেই বাংলা সাহিত্যের এই বহুমুখী প্রতিভাধর পুরুষটিকে আমাদের সান্নিধ্য থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। আধুনিক বাংলা কাব্য জগতে বুদ্ধদেব বসু একটি অনন্য নাম। তিনি প্রধানতঃ কবি ছিলেন। কিন্তু সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। আধুনিক কাব্যের সমালোচক হিসেবে তাঁর কীর্তির তুলনা তিনি নিজেই। এছাড়া অননুকরণীয় গদ্য রচনার ক্ষেত্রেও তিনি সদা ভাস্বর। উপন্যাস এমনকি শেষ জীবনে কাব্যনাট্য রচনায়ও তাঁর অপরিসীম দক্ষতা সর্বজনস্বীকৃত সত্য। ভিন্নদেশীয় কবিতার অনুবাদ কর্মেও তিনি ছিলেন অনলস। মোদ্দা কথায়, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলা কাব্য জগতে এক নতুন দিকের উন্মোচন ঘটেছে। রবীন্দ্র সাহিত্যের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সাহিত্যকে নতুন খাতে প্রবাহিত করার জন্যে তিনি ছিলেন এক অগ্রগামী কবিপুরুষ। প্রগতি এবং কবিতা পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতার চাষ করেছিলেন। এবং এই দু’টি পত্রিকার প্রভাব আজকের স্বনামধন্য কবিদের জীবনে একেবারে কম নয়। বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্র প্রভাব থেকে সাহিত্য জগতকে মুক্ত রার জন্যে দুর্দান্ত দুঃসময়ের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথকে কখনো অবমাননা করতে উদ্যোগী হননি। তিরিশের যুগে তিনি কল্লোল গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর শৈশব এবং যৌবনের কিছুটা কাল ঢাকায় কেটেছে। ঢাকা সম্পর্কিত স্মৃতিচারণায় তিনি সেকালের ঢাকাকে আমাদের চোখে দীপ্তিময় করে তুলেছেন। ইংরেজী সাহিত্যে তিনি পড়াশোনা করেছেন। তাই তিনি স্বভাবতঃই বিদেশী সাহিত্যের প্রতি ছিলেন অনুরাগী। তাঁর এই অনুরাগের পরিচয়কে তিনি আরো গভীর করেছেন, বিদেশের বিভিন্ন সাহিত্যিকদের কবিতা অনুবাদ করে। অনুবাদের মতো দুরূহ কর্মে তিনি নিজেকে সমর্পিত করে দিয়েছিলেন। কারণ, কবিতার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। বুদ্ধদেব বসুর অসাধারণ লেখনীর ফলে বহু কবিই উপকৃত হয়েছেন এবং আধুনিক কবিতার একটি বৃহৎ পাঠক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। তিনি যে নিষ্ঠা ও বৈদগ্ধের পরিচয় দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যে খুব কমই দেখা যায়। বুদ্ধদেব বসু লোকান্তরিত হওয়াতে বাংলা সাহিত্যে এক শূন্যতার সৃষ্টি হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তিনি না থাকলেও কিছু কাব্যপ্রেমিক রয়ে গেছেন যাঁদের মধ্যে তাঁর কবি সত্তা বেঁচে থাকবে। বুদ্ধদেব বসুর মতো বিশুদ্ধ সাহিত্য সেবী সচরাচর জন্মগ্রহণ করবেন না জানি। বুদ্ধদেবকে আমরা আর কোনোদিন পাবো না। কিন্তু তিনি বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন, তা কোনোদিন আমাদের স্মৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেনা। আমরা তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক