You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইত্তেফাক
২০শে মে ১৯৬৪

গণদাবীর প্রশ্নে কাহারও সহিত কোন আপােষ নাই
খুলনার কর্মীসভায় শেখ মুজিব কর্তৃক আওয়ামী লীগের নীতি ব্যাখ্যা

(ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি প্রেরিত)
খুলনা, ১৭ই মে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়া অদ্য স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হলে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সুদূর সুন্দরবন এলাকাসহ জেলার প্রত্যন্ত প্রদেশ হইতে প্রায় পাঁচশত কর্মী এই সম্মেলনে যােগদান করেন। আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সফরকে কেন্দ্র করিয়া কর্মীদের মধ্যে প্রবল প্রাণবন্যা এবং অভূতপূর্ব কর্মচাঞ্চল্য পরিদৃষ্ট হয়। পার্শ্ববর্তী জেলা যশাের ও ফরিদপুরের বিভিন্ন অঞ্চল হইতেও আওয়ামী লীগের জেলা নেতৃবৃন্দ ও কর্মিগণ খুলনার কর্মী সম্মেলনে যােগদান করেন। যশাের হইতে আওয়ামী নেতা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব আবদুল খালেক ও প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী জনাব মশিউর রহমান সহ প্রায় ৫০ জন কর্মী সম্মেলনে যােগদান করেন। ফরিদপুর জেলার সদর এবং গােপালগঞ্জ মহকুমা হইতেও প্রায় অর্ধশত কর্মী সম্মেলনে যােগদান করেন। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতাদান প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের গােড়াপত্তন, গণতন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ সংগ্রাম, স্বল্পকালীন আওয়ামী লীগের শাসনে গণমঙ্গল মানসী ব্যবস্থাদি গ্রহণ এবং দলের পুনরুজ্জীবন প্রশ্নসহ দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলােচনা করেন। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগের ইতিহাস যুগপৎ দুঃখ ও সাফল্যের ইতিহাস। বিশ্লেষণ করিয়া তিনি বলেন যে, ১৯৪৯ সালে তদানীন্তন পরাক্রমশালী মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য যে সময়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই সময়ে বিরােধী দল গঠন একটি অচিন্তনীয় ঘটনা ছিল। তিনি কর্মীদের স্মরণ করাইয়া দেন যে, স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করিতে গিয়া তদানীন্তন আওয়ামী লীগের কর্মীরা জানিতেন যে, অত্যাচার-অনাচার, উৎপীড়ন-নিপীড়ন তাঁহাদের ভােগ করিতে হইবে এবং অদূর ভবিষ্যতে কোনদিন তাহারা ক্ষমতার অধিকারী হইবেন না। শেখ সাহেব বলেন যে, ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ সরকার শুধুমাত্র যে পরাক্রমশালী ছিল তাহাই নহে- দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনও এই সরকারের পিছনে ছিল। সেই অবস্থায় আওয়ামী লীগের নিঃস্বার্থ ও দুর্দমনীয় কর্মীরা সাধারণ মানুষের পক্ষ সমর্থন করিয়া পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, আন্তঃপ্রাদেশিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বীকৃতি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীসহ সকল জনপ্রিয় দাবী আদায় বা উত্থাপন করে। শেখ সাহেব বলেন যে, এই সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করিলে প্রতীয়মান হয় যে, আওয়ামী লীগের ইতিহাস যুগপৎ দুঃখ ও সাফল্যের ইতিহাস।
শেখ মুজিব কর্মীদের বলেন যে, একটি রাজনৈতিক দলের সার্থকতা উহার নেতৃত্ব, কর্মসূচী, সংগঠন এবং নিঃস্বার্থ কর্মীদের উপর নির্ভরশীল। তিনি ঘােষণা করেন যে, বর্তমানে দেশে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল- যার এই সবকিছুই বর্তমান রহিয়াছে। তিনি বলেন যে, শহীদ সােহরাওয়ার্দী ইন্তেকাল করিলেও তাঁহার অমর নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের সম্মুখে দেদীপ্যমান রহিয়াছে এবং মরহুম নেতার আদর্শ ও আকাংক্ষাকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগের অগণিত কর্মীর উপর বর্তাইয়াছে। দলের কর্মসূচী সম্বন্ধে তিনি বলেন যে, অত্যল্প কালের মধ্যেই খসড়া কর্মসূচী সাধারণ্যে প্রকাশ করা হইবে এবং এই খসড়া কর্মসূচী সম্পর্কে সর্বসাধারণের মতামত গ্রহণ করা হইবে। পরবর্তী পর্যায়ে সাধারণের মতামত পর্যালােচনা করিয়া আগামী কাউন্সিল অধিবেশনে চূড়ান্ত কর্মসূচী অনুমােদন করা হইবে। দলের সাংগঠনিক ও কর্মী বাহিনী সম্পর্কে শেখ সাহেব বলেন যে, দীর্ঘকালের রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্বের পরে আজও বাংলার দূর দূরান্তে আওয়ামী লীগের সংগঠন আছে, আওয়ামী লীগ নামটি সাধারণের কাছে পরিচিত এবং বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম নাই, যেখানে আওয়ামী লীগের নিঃস্বার্থ কর্মী নাই। দলের নীতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেন যে, জনসাধারণের মুক্তির জন্য সকলের সহিত মিলিয়া ঐক্যবদ্ধ সগ্রাম করিতে আওয়ামী লীগ সর্বদাই প্রস্তুত। এই দেশের গণ-আন্দোলনের পূর্বাপর আলােচনা করিয়া শেখ সাহেব বলেন যে, যাহারা গণ-আন্দোলনের নাম করিয়া আপােষ ফর্মুলা উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করে, সেই প্রতিক্রিয়াশীলদের সহিত মিলিয়া ঐক্যের নামে দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এমন গণ-আন্দোলনের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করিতে আওয়ামী লীগ প্রস্তুত নহে। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেন যে, আন্দোলনের পথে কোন সংক্ষিপ্ত ব্যবস্থা নাই এবং যাহারা নানা অজুহাতে যথার্থ দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত গণ-আন্দোলন সংক্ষেপ করেন, তাহাদের সহিত আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক নাই। শেখ মুজিবর রহমান ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং উহা কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। সুতরাং স্বভাবতঃই জনসাধারণের জন্য মঙ্গলজনক ব্যবস্থাদি গ্রহণের মত পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে সৃষ্টি করিতে হইবে। মৌলিক গণতন্ত্রী মহলে কর্মীদের কর্মতৎপর হওয়ার জন্য পরামর্শ দান প্রসঙ্গে শেখ সাহেব বলেন যে, মৌলিক গণতন্ত্রীরা এই দেশেরই মানুষ, হয়তােবা নানা ধরনের লােভ-লালসার মুখে তাঁহারা সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছেন। তিনি কর্মীদের স্মরণ করাইয়া দেন যে, দেশের ও দশের স্বার্থের কথা উহাদের বুঝাইয়া দিলে তাঁহারাও দেশবাসী ও দেশের পক্ষে ফিরিয়া আসিবেন। কর্মী সম্মেলনের উপস্থিতি এবং কর্মীদের প্রাণচাঞ্চল্য দেখিয়া শেখ সাহেব সন্তোষ প্রকাশ করেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!