বাংলার বাণী
ঢাকা : ২১শে মার্চ, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ৭ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে সফল করতে হবে
প্রগতির উপর প্রতিক্রিয়ার হামলা চিরন্তন। পৃথিবীর সকল দেশেই সকল যুগেই দেখা গেছে যে, যেখানে প্রগতি প্রতিক্রিয়ার সকল আঘাতকেই সফলভাবে মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছে, সেখানেই প্রতিক্রিয়ামণে কামড় দিয়েছে তার অগ্রযাত্রায়। আমাদের এই বাংলাদেশেও তার বাইরে কিছু ঘটছেনা। ত্রিশ লক্ষ লোকের রক্ত পিচ্ছিল পথে যে স্বাধীনতা সূর্য এই বাংলার দিকভালে উদিত হয়েছে আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে, সেটাও ছিল প্রতিক্রিয়ার সকল ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে প্রগতিরই জয়যাত্রা। কিন্তু প্রতিক্রিয়া তো আর বসে নেই। সে এই জয়যাত্রা এই অগ্রযাত্রায় বাঁধা দেবার জন্যে সব সময়ই তৎপর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ওরা যতগুলো সুযোগই পেয়েছে, তার সব ক’টির ব্যবহার করেছে দেশের কষ্টলব্ধ স্বাধীনতা, আভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা, দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং প্রগতি ও সমৃদ্ধির বিরুদ্ধে। তেমনি আচরণ করছে এখন এই দেশে তথাকথিত বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। এদের মধ্যে সবার উপর টেক্কা দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নাম রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচয় দানকারী একটি অরাজনৈতিক তথা সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী দল। বাহাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে জন্মলাভের পর থেকে এই দলের নেতারা এ যাবত যতগুলো বক্তব্য রেখেছেন—যতগুলো কর্মসূচী পেশ করেছেন, তার কোনটিই নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনসুলভ নয়ই—পরন্তু এটাকে দেশদ্রোহীমূলক হিংসাত্মক তৎপরতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এবং তার চূড়ান্ত পরিচয় তাঁরা দিয়েছে হঠকারী পন্থায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ী আক্রমণ করে নির্মমভাবে কিছু জীবন নষ্ট করার মাধ্যমে। ওরা আসলে দেশে গণতন্ত্রের নামে নৈরাজ্যের রাজনীতি চালাতে চায়।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারী দল গোড়া থেকেই ওদের বক্তব্য ও কার্যকলাপ সম্পর্কে কোনো সচেতনতা দেখাননি এবং ওদের এসব তৎপরতা চালানোর জন্যে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দিয়েছেন। যদি তা না হতো, যদি গোড়া থেকেই ওদের প্রশ্নে সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা হতো তবে একটি অমূল্যজীবনও এভাবে অকালে আর ঝরে পড়তে পারতো না। যাহোক এসব গণবিরোধী, হঠকারী, এ্যানাকিষ্ট দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যে ক্ষমতাসীন দল, তার সাহায্যকারী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং তার সহযোগী গণসংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে আগামী চব্বিশে মার্চ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালনের ডাক দেয়া হয়েছে। এখন এই প্রতিরোধ দিবসকে সফল করে তুলতে হবে এবং এই সফল করে তোলার দায়িত্ব গোটা জাতির। গণপ্রতিরোধ দিবস সফল করে তোলার পর্যায়ে গত মঙ্গলবার বায়তুল মোকাররমে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এই গণজমায়েতে ভাষণদানকালে নেতৃবৃন্দ প্রতিরোধ দিবস সফল করে তোলার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
ঐ গণজমায়েতে ভাষণ দানকালে নেতৃবৃন্দ বলেছেন জাসদের তথাকথিত বিপ্লবী নেতারা দেশে গণতন্ত্র চায়না—তারা চায় মার্কিন পুঁজিপতিদের আস্তানা এদেশে প্রতিষ্ঠা করতে। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর এজেন্টরা চোরাচালানী ও মওজুতদারদের দ্বারা ষড়যন্ত্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। দুর্নীতিবাজ আমলা ও অসাধু ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খাচ্ছে। গণপ্রতিরোধ দিবসে এদের সকলকেই সমূলে উৎখাত করার শপথ নিতে হবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের কল্যাণে যে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়ে তোলার আজন্ম লালিত জাতির পিতার স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে হবে এবং সেজন্যেই প্রতিটি দেশপ্রেমিক কর্মীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এবং কর্মতৎপরতা আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন বলে আমরা বিশ্বাস করি।
পরিশেষে, আমরা দেশের সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলবো যে, সমাজবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে না পারলে তা দেশ ও সমাজের জন্যে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং সেদিকে লক্ষ্য রেখে দেশের সামগ্রিক স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে আজ সফল করে তুলতে হবে। এ দায়িত্ব সকলের।
জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন
অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমতা বিধানের বিষয়ে আলোচনার জন্যে নেতৃস্থানীয় সতেরোটি জোটনিরপেক্ষ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গত ১৯শে মার্চ আলজিয়ার্সে এক সম্মেলনে মিলিত হয়েছেন। এ সম্মেলনে তাঁরা বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থায় আলোচনার প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। বিশ্ব সংস্থায় এ বিষয়ে কিভাবে আলোচনা করা হবে, কি কি বক্তব্য রাখা হবে তা নিয়ে এ সম্মেলনে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে। সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন যুগোশ্লাভিয়া, ভারত, আলজিরিয়া, কিউবা, গায়ানা, কুয়েত, লাইবেরিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, পেরু, সোমালিয়া, সিরিয়া, সেনেগাল, তানজানিয়া, জায়ার ও মালি। চিলিকে আহ্বান জানানো হয়নি। কারণ সেখানে ফ্যাসিস্ট সরকার বিদ্যমান।
জোটনিরপেক্ষ সতেরো জাতি সম্মেলনে প্রধানতঃ দু’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। প্রথমতঃ আগামী ৯ই এপ্রিলে নিউইয়র্কে কাঁচামাল সম্পর্কে জাতিসংঘের যে সম্মেলন হবে তার প্রস্তুতি। দ্বিতীয়তঃ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
তেল সমস্যা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এ সম্মেলনে আলোচনা করা হবে। কেননা, শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সমতা বিধানের যেকোনো আলোচনায় তেল সংকট অপরিহার্যভাবেই এসে পড়বে। যে সব দেশ কাঁচামাল উৎপাদন করে স্বাভাবিকভাবেই তারা চায় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মতো তারাও একটি ব্লক গড়ে তুলতে। তামা ও বক্সাইট উৎপাদনকারী দেশগুলো তো ইতিমধ্যেই ব্লক গঠন করেছে।
গত ১৮ই মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিলিত হয়েছিলেন এক ঘরোয়া বৈঠকে। গায়ানার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবটি হলো উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশগুলোর জন্য তেলের বিশেষ ব্যবস্থা করা। সব দেশের আবার কাঁচামাল নেই। এরা একতরফভাবে শিকারে পরিণত হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর। এদের জন্য একটি তহবিল গঠনেরও প্রস্তাব রয়েছে। প্রস্তাবে রয়েছে এসব দেশের জন্য জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর। এসব দেশগুলো একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।
আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন নানান দিক দিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমন একটা সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন হচ্ছে যখন উন্নয়নশীল দেশগুলো তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন। অধিকাংশ দেশগুলোর বার্ষিকী পরিকল্পনাগুলোকে কেটে ছেটে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হচ্ছে। তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে দ্বিগুণ তিনগুণ বেশী বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রয়োজন তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা। তবে এ কথা সত্য যে, শিল্পোন্নত দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে কাঁচামাল (তেলও এর মধ্যে রয়েছে) নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলেছেন তা আর বিশদভাবে বর্ণনা করার অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সস্তা দরে কাঁচামাল নিয়ে তারই সাহায্যে পণ্য উৎপাদন করে তা দ্বিগুণ তিনগুণ দামে বিক্রি করেছে এতদিন পর্যন্ত। আর এ মুনাফার সিংহভাগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। কিন্তু তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো ইসরাইল-আরব যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জোটবদ্ধ হওয়ার পরই টনক নড়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর। পরিত্রাহি চিৎকার শুরু হয়েছে সেখানে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পোন্নত দেশগুলো আজ বাঁধা হয়েছে তাদের অতীত ভূমিকা পরিবর্তন করতে। উদাহরণস্বরূপ জাপান ও ফ্রান্সের কথাই বলা যায়। তেল যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জাপান তার ইসরাইল ঘেঁষা নীতি পাল্টেছে।
কাঁচামাল নিয়ে ব্লক গঠনের যে প্রস্তাব উঠেছে সে সম্পর্কে আজ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ভাবনা চিন্তা করতে হবে। আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের সম্মেলনে কাঁচামাল নিয়ে আলোচনা হবে। জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে কাঁচামাল সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট বক্তব্য ও নীতি গ্রহণ করা হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কাঁচামাল নিয়ে অতীতে যে ছিনিমিনি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে তা রোধ করতে না পারলে উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না। তা সম্ভবও নয়। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থে কাঁচামাল সম্পর্কিত একটা সুস্পষ্ট নীতি প্রণয়ন করা। যেমন নীতি প্রণয়ন করেছেন আজকের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক