You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৯শে মার্চ, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ৫ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

অর্থনীতি সম্মেলন ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

এক পাহাড়-প্রমাণ জাতীয় সমস্যা, হতাশা আর অনিশ্চয়তার ধোঁয়াটে কুয়াশাকে সামনে রেখে গত রোববার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থনীতি সম্মেলন শুরু হয়েছে। এটি আয়োজন করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। আজ তার সমাপ্তির দিন।
এর উদ্বোধন করেন আমাদের রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদউল্লাহ। এতে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞেরা ছাড়াও অনেক বিদেশী অভ্যাগতেরাও অংশ নিচ্ছেন। এ সম্মেলন উপলক্ষে প্রেরিত এক শুভেচ্ছা বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিবুর রহমান বলেন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও দ্রুত অগ্রগতির পথ নির্দেশে দেশের অর্থনীতিবিদদের খোলাখুলিভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও অপরিশোধিত তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় কিভাবে উপযুক্ত সামঞ্জস্য বিধান করা যায়, সে জন্যে তিনি অর্থনীতিবিদদের প্রতি এক উদাত্ত আহ্বান জানান।
উদ্বোধনী ভাষণে রাষ্ট্রপতি দেশের সংকট কাটিয়ে সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত পরামর্শ দেবার জন্যে উপস্থিতি সুধীমন্ডলীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি স্বীকার করেন যে, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে অনেকটা উন্নতিসাধিত হলেও আমরা এখনো যুদ্ধ পূর্বকালীন পর্যায়ে পৌঁছুতে পারিনি। এজন্যে তিনি দু’টো প্রধান কারণ চিহ্নিত করেন : একটি দেশের বলগাহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরটি আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি।
এ সম্মেলনে যারা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে অন্যান্যের মধ্যে আছেন সমিতির সভাপতি ডঃ মযহারুল হক, ডঃ নূরুল ইসলাম ও আরো অনেকে। প্রথম দিনের আলোচনায় বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। এতে বক্তারা প্রায় সবাই লিখিত বক্তব্য রাখেন। প্রায় সবার আলোচনাই অত্যন্ত সরস প্রাণবন্ত ও গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। আর এভাবে এক একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে এক একবার আলোচনা করা হলে দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পথ নির্দেশ পাওয়া যাবে বলেই সবার ধারণা। সত্যিই ডঃ হকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও মনে করি যে, দেশের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদদের প্রধান কাজই হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন দোষ-ক্রুটি দেখিয়ে দিয়ে সমস্যা সমাধানে সরকারকে সাহায্য করা। আজ যে অর্থনীতিবিদ দেশের এমন মরোণোন্মুখ অবস্থায় নীরব দর্শকের মতো চুপচাপ বসে থাকবেন, তাকে আগামী দিনের কাছে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
এটা সত্যিই খুব পরিতাপের বিষয় যে, গত দু’বছর দেশ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে দেশের কোনো অর্থনীতিবিদ এমন কোনো পরিষ্কার বক্তব্য রাখেননি যাতে দেশের মানুষ জানতে পারে যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও পরিকল্পনা ঠিক কি হওয়া উচিত, কিম্বা সরকার দেশ গঠনে যে নীতি গ্রহণ করেছেন তার যৌক্তিকতাই বা কতটুকু।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক অবস্থা আজ এমন পর্যায়ে এসেছে যে, এর উদ্ভব সম্পর্কে যে কোনো প্রকৃত পরিকল্পনা নিতে গেলে শুধুমাত্র অর্থনীতিবিদদের বক্তব্যের উপর ভরসা করলে চলবেনা। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞদের অভিমত ও উপদেশও গ্রহণ করতে হবে। কারণ আমাদের দেশের জন্য যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা এখন সামাজিক প্রকৌশলী বা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পর্যায়ভুক্ত।
দেশের জন্য সত্যিকারের ব্যবস্থা নিতে হলে প্রথমেই পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে রচিত পরিকল্পনার যথার্থতা কতটুকু তা জানতে হবে। এছাড়া যাদের জন্য পরিকল্পনা নেয়া, তাদের সম্ভাব্য সর্বপরিস্থিতিতে আচরণ কেমন, সে সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে প্রথম কাজ হচ্ছে সমাজকে উন্নয়নকারী ও উন্নয়নপন্থী করে গড়ে তোলা অথচ, এ কাজ শুধুমাত্র এককভাবে অর্থনীতিবিদদের দ্বারা সম্ভব নয়।
যে কোনো সুষ্ঠু ও বাস্তব ভিত্তিক পরিকল্পনার মধ্যে যে সব বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় নির্দিষ্ট হওয়া উচিত তার মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি, কালো পয়সা বিনিয়োগ বাধ্য ও ব্যবস্থা, সঞ্চয়, শিল্পায়ন উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার্জন ইত্যাদি প্রধানভাবে উল্লেখ্য।
অথচ, অনেকেরই অভিযোগ যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিকল্পনা কোনো সুচিন্তিত ভাবনার ফল নয়। এতে কমিশন অনেক মূল্যবান দিকের প্রতি স্রেফ অন্ধত্ব প্রকাশ করেছেন যেমন দ্রব্যমূল্যের ওঠানামার ঠিক স্বরূপ কি বা কতটুকু পর্যন্ত এ উঠতে পারে কিম্বা উঠলে প্রণীত পরিকল্পনার উপর এ কিভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে ইত্যাদি। ফলে যে মূলযাত্রা ধরে নিয়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটি নেয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে বর্তমান মূল্যমাত্রার তফাৎ আকাশ পাতাল। ফলে, অভাবিত অর্থ সংস্থানের অভাবে পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর পুঁজির ক্ষেত্রে যে হাত বদল হয়েছে। তাতে দেশের এক বিপুল পরিমাণ সম্পদ কালো হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে কিম্বা বিদেশে পাচার হয়েছে। এদের সদ্ব্যবহার করার ব্যবস্থা করতে পারলে দেশের প্রভূত উন্নতি হতো। অথচ, কমিশন এ কালো অর্থ সদ্ব্যবহার হবার জন্য যে ইনসেন্টিভ সৃষ্টির প্রয়োজন, তা’ মোটেই করতে পারেননি। একদিকে দেশে উৎপাদন ব্যাহত, অন্যদিকে যে সম্পদ আছে তাও গোপন প্রকোষ্ঠে বন্দী। যার ফলে দিনে দিনেই মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, দেশে বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর সরকারকে নোট ছাপিয়ে ছাপিয়ে প্রয়োজন মিটিয়ে দেউলিয়া হতে হচ্ছে।
অনেকের অভিযোগ যে, কর্তৃপক্ষ একে তো পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জনসাধারণকে আকৃষ্ট করতে পারেননি, তার উপর যে নীতিতে পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবস্থা করেছেন তা’ সম্পূর্ণই সঞ্চয় ও বিনিয়োগবিরোধী।
স্বাধীনতার আগে যে সব স্বল্প আয়সম্পন্ন লোকেরা বিভিন্ন শিল্পের মূলধনে যোগান দিতে বা সরকারকে সাহায্য করতে এস.আই.টি, আই.সি.পি সহ যে সব বিভিন্ন শেয়ার কিনেছিলেন, তারা আজ নিঃস্ব। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন অবসর গ্রহণকারী কিম্বা বিধবা। এরা হিসাব করেছিলেন যে, বিনিয়োগের অর্থ থেকে সারা বছর এরা সংসার চালাতে পারবেন। কিন্তু গত চার বছরে এরা নাকি একটা পয়সাও পাচ্ছেন না। ফরে, বিনিয়োগে অন্যান্যেরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। অথচ, এদের ও জনসাধারণের উৎসাহ বাড়ানোর জন্যে কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনায় তেমন লক্ষণীয় ব্যবস্থা নেননি।
তা’ ছাড়া দেশে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক না হলে কোনো সঞ্চয় পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। এমনকি সব সুযোগ-সুবিধা দিলেও নয়। অনেকে তো তার পুঁজি খেয়েই বেঁচে আছে। ফলে আগামী ৫ বছরের জন্যে কমিশন যে আভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের গণনা করেছেন তা নিতান্তই হাস্যস্পদ বলে সবার ধারণা।
ওদিকে সমাজতন্ত্র ঠিক রাখতে সব শিল্পগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে। অথচ, এদের বাঁচিয়ে রাখতে যে রাজস্ব চালার প্রয়োজন, তার কোনোই যোগান নেই। বিদেশী সাহায্য ও পুঁজি বিনিয়োগের উপর একটা বিরাট ভরসা করে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, অথচ সে অর্থ পাবার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববাসী সমস্ত দেশের চেয়ে রেকর্ড পরিমাণ সাহায্য বাংলাদেশকে দিয়েছে অর্থাৎ প্রায় ২৬০০ কোটি টাকার খাদ্য সামগ্রী ও অন্যান্য সাহায্য দিয়েছে। অথচ, আমাদের পেটে এখনো ক্ষুধা। এগুলো কোথায় কিভাবে বন্টন করা হলো তার হিসেবও অস্পষ্ট। ফলে, বিদেশী খয়রাতেরও আর আশা নেই।
এ বছর ১৫ লা্খ টন যে খাদ্য ঘাটতি আছে তা পূরণ করতে গম কিনলে মওজুত বৈদেশিক মুদ্রা নাকি সম্পূর্ণ খরচ হয়ে যাবে। পাটের বাবদ যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে বলে পরিকল্পনায় ধরা হয়েছিল, এখন ‘উটোপীয় আশা’ ছাড়া আর কিছু নয়। পাটের আগুনে সমস্ত বিশ্ব স্তম্ভিত।
এ বাদে গ্যালোনিং মুদ্রাস্ফীতির ফলে কতটুকু অর্থের প্রয়োজন তাও নাকি কমিশন জানেন না বলে জনৈক অর্থনীতিবিদ অভিযোগ তুলেছেন।
এইভাবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও বিভিন্ন অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এ কথা স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, বাংলাদেশে যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা’ নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হয়ে দেশ ও জাতির দুর্গতি ও দুর্দশা বাড়াতে বাধ্য। কারণ, এতে কমিশন দূরদর্শিতা দেখাতে বা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে সম্পূর্ণই ব্যর্থ হয়েছেন।
সুতরাং, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের নিবেদন যে, এই মুহূর্তেই যেন বর্তমান পরিস্থিতি ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যৌক্তিকতার যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমনকি প্রয়োজন পড়লে সর্বস্তরের বিশেষজ্ঞদের অভিমত ও প্রস্তাব যাচাই করে প্রণীত পরিকল্পনাকে যেন নতুনভাবে ঢালাই করা হয়। তা না হলে এদেশ রক্ষা করা খুবই দুষ্কর হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!