ইত্তেফাক
৯ই মার্চ ১৯৬৪
পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র আদায়ে দৃঢ় সংকল্প ঘােষণা
আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রস্তাব গ্রহণ
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
গতকল্য (রবিবার) মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশ মােতাবেক দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকল্পে গ্রামে গ্রামে গণতন্ত্রের দুর্ভেদ্যব্যুহ গড়িয়া তােলার ইস্পাত-কঠিন শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিনদিবসব্যাপী কাউন্সিলার ও ডেলিগেট সম্মেলন সমাপ্ত হয়। প্রদেশের প্রতিটি জেলা হইতে আগত ৯ শত ৪৪ জন কাউন্সিলার ও ডেলিগেট, পশ্চিম পাকিস্তানী ৭ জন নেতা এবং ১২ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে এক পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র আদায়ের সঙ্কল্প ঘােষণা করিয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। উক্ত প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, ঐ শাসনতন্ত্রে পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের প্রাধান্য ঘােষণা, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জনগণকে সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষমতা এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দান করিতে হইবে। ঐ শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের সমান। উন্নয়ন এবং দুই অংশের মধ্যে বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন, পূর্ব পাকিস্তানকে দেশরক্ষা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল করা, ফেডারেল ধরনের পার্লামেন্টারী সরকার ব্যবস্থা, সংবাদপত্র ও সংগঠনের মারফত জনমত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতাসহ জনগণকে রাজনৈতিক দল গঠন ও সংগঠনের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দান, বেআইনীভাবে গ্রেফতার ও বিনা বিচারে আটক রাখা হইতে অব্যাহতি দান এবং মৌলিক অধিকারকে বিচার বিভাগের এখতিয়ারে আনয়ন এবং বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হইতে পৃথকীকরণের নীতি সন্নিবেশেরও দাবী জানান হয়। নির্দেশপ্রার্থী কর্মীসমাজ ভবিষ্যৎ আন্দোলনের এই পথনির্দেশ গ্রহণ করিয়া গ্রামে গ্রামে গণআন্দোলন গড়িয়া তােলার শপথ গ্রহণ করিয়া সম্মেলন ত্যাগ করেন।
প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা হইতে আগত আওয়ামী লীগ কাউন্সিলার ও ডেলিগেটগণ গত তিনদিনে দেশের সমস্যাদি সম্পর্কে বিপুল উৎসাহউদ্দীপনার মধ্য দিয়া আলাপ-আলােচনা করেন। সুদীর্ঘ ৭ বৎসর পরে আয়ােজিত এই সম্মেলন কর্মীদের মনে যে নবপ্রেরণার সৃষ্টি করে এবং যে নবমন্ত্রে দীক্ষা দেয় উহারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই সম্মেলনে।
গতকল্য সকাল সাড়ে ৯টায় গ্রীণ রােড আম বাগানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিনদিবসব্যাপী কাউন্সিলার ও ডেলিগেট সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশন শুরু হয়। বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্যের বক্তৃতা জবাবদান প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেন ঃ আমি মােবারকবাদ জানাই আওয়ামী লীগের কর্মীদের, যারা অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সহিত মিলিয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রােধ করিয়াছিলেন। আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য মানবসেবা এবং কোন সম্প্রদায়ের বিরােধিতা নয়। যে কোন মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখিতে হইবে। ইসলামের নির্দেশ আছে বিপন্ন মানবতার সেবা করার। জীবন দিয়া প্রতিবেশীর প্রাণ রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। মরহুম নেতা সােহরাওয়ার্দী নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়াছেন এবং এজন্য তিনি যখন ঢাকায় আসেন তখন তাঁহাকে পাকিস্তান হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দাঙ্গা চায় না। প্রত্যেক সরকারের দায়িত্ব হইতেছে তার নাগরিকদের রক্ষা করা। এই দায়িত্ব পালনে অক্ষম সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। ভারতে এবং পাকিস্তানে যে দাঙ্গা হইয়া গেল, উহার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কংগ্রেস সরকারের এবং পাকিস্তানের আইয়ুব-মােনায়েম সরকারের পদত্যাগ করা উচিত ছিল। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেন ঃ শহীদ সাহেবের মৃত্যুর পর নেতৃবৃন্দ ঘুমাইয়া পড়েন। এমনি ধরনের পলায়নী মনােবৃত্তি দেখা দেয় যে, ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি হইলে নরসিংদী যাইয়া জনসভা অনুষ্ঠান করা হয়। কোটারী করা যাদের অভ্যাস, নেতা হওয়াই যাদের লক্ষ্য, যারা মাঠে যাইয়া আন্দোলন করিতে এবং ত্যাগ স্বীকার করিতে প্রস্তুত নয়, তাহারাই কেবল চুপ করিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ত্যাগ স্বীকারই যার ঐতিহ্য, তার পক্ষে চুপ করিয়া বসিয়া থাকা সম্ভব নয়। আজ পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনে যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীরা অতীতের ন্যায়ই প্রস্তুত আছে। যে কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী দল পুনরুজ্জীবনকে স্বীকার করিয়া লন নাই তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া শেখ মুজিবর রহমান বলেন ঃ মরহুম সােহরাওয়ার্দী গণতন্ত্রের পূজারী ছিলেন। তাঁর অনুসারী বলিয়া যারা দাবী করেন, তাঁদের উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠদের সিদ্ধান্ত মানিয়া লইয়া দলে ফিরিয়া আসা। দলে ফিরিয়া আসিলে তাহাদিগকে স্বাগত জানান হইবে। কিন্তু ফিরিয়া না আসিলে তাঁহাদের আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহারের কোন অধিকার থাকিবে না। এন,ডি,এফ’ সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেন ঃ সকল দল পুনরুজ্জীবিত হইবার পর মূল ‘এন,ডি,এফ’-এর আর কোন অস্তিত্ব নাই এবং বর্তমান কোটারী এন,ডি,এফর সহিত আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক নাই। এক্ষণে নিম্নতম কর্মসূচী অর্থাৎ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচনের দাবীতে সকল দল ও গণতান্ত্রিক শক্তির সমবায়ে একটি সম্মিলিত সক্রিয় গণআন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য পাওয়া আদায় সম্পর্কে শেখ মুজিবর রহমান বলেন ঃ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমাদের কোন সংগ্রাম নাই। যারা গৃহহারা হইয়া পাকিস্তানে আসিয়াছেন, তাহাদের বিরুদ্ধেও আমাদের কোন সংগ্রাম নাই। আমাদের সংগ্রাম তাহাদের বিরুদ্ধে যাহারা দেশের সমস্ত সম্পদ সামান্য কয়েকটি পরিবারের হাতে তুলিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছে, যে স্বৈরতন্ত্র জনগণের সকল ক্ষমতা কাড়িয়া লইয়াছে এবং যাহারা সামান্য কয়েকজনকে ধনী আর বাকী সকলকে দরিদ্র করিয়াছে। এ- সংগ্রাম ন্যায্য সংগ্রাম, এদাবী ন্যায্য দাবী। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দও এ দাবী সমর্থন করেন।
শেখ মুজিবর রহমান বলেন ঃ একটি দলের মােট ৪টি স্তম্ভ থাকে। যথা নেতৃত্ব, প্রতিষ্ঠান, কর্মী ও আদর্শ। আওয়ামী লীগের এ-চারটি স্তম্ভই আছে। আর যে দলের উদ্দেশ্য মহৎ, যে দল দেশের মানুষকে ভালবাসে, সে দল অধিকার আদায়ে কখনও বিফলকাম হইতে পারে না। মরহুম সােহরাওয়ার্দীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া শেখ মুজিবর রহমান বলেনঃ মরহুম সােহরাওয়ার্দী একটি আওয়ামী লীগ পরিবারের সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন। কংগ্রেস যেমন গান্ধীর নাম বাঁচাইয়া রাখিয়াছে, আওয়ামী লীগও তেমনি সােহরাওয়ার্দীর নাম বাঁচাইয়া রাখিবে। সমাপ্তি অধিবেশনে পাকিস্তান। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মুলতানের জনাব আরশাদ চৌধুরী এবং করাচীর জনাব আমানউল্লা কাদরীও বক্তৃতা করেন। তাঁহারা পশ্চিম পাকিস্তানে বিরােধী দল যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হইতেছেন, তৎসম্পর্কে আলােকপাত করেন।
ইহাছাড়া ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, নােয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব নূরুল হক, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব এম, এ, আজিজ, প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব দিলদার আহমদ, জাতীয় পরিষদ সদস্য সৈয়দ হােসেন মনসুর, দিনাজপুরের জনাব আজিজুর রহমান, কুমিল্লার জনাব আবদুল মতিন পাটোয়ারী সাংগঠনিক বিষয় সম্পর্কে আলােচনা করেন।
অতঃপর সাবজেক্ট কমিটি প্রণীত প্রস্তাবগুলি পেশ করেন শাহ আজিজুর রহমান এবং জনাব তাজুদ্দিন আহমদ। প্রস্তাবগুলি সমর্থন করেন হাফিজ হাবিবুর রহমান। জনাব শামসুল হক সম্পর্কিত প্রস্তাবটি পেশ করেন। ময়মনসিংহের জনাব জুলমত আলী খান এবং সমর্থন করেন কুষ্টিয়ার জনাব সাদ আহমদ। মােট ২৬টি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। মুহুর্মুহু ‘সােহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’, ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’, ‘গণতন্ত্র কায়েম কর’ প্রভৃতি শ্লোগানের মধ্যদিয়া সম্মেলন সমাপ্ত হয়।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব