You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.03.07 | আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্ট | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
৭ই মার্চ ১৯৬৪

আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্ট

গতকল্য (শুক্রবার) ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ও ডেলিগেট অধিবেশনে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান নিম্নোক্ত রিপাের্ট পেশ করেনঃ
জাতীয় জীবনের এক যুগসন্ধিক্ষণে আমরা এই সম্মেলনে মিলিত হয়েছি। আজ সবচেয়ে বেশী অনুভব করছি আমাদের প্রিয় নেতা আওয়ামী লীগের কর্ণধার, পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্রের অতন্দ্র সংগ্রামী বীর সেনানী মরহুম জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর অভাব- যিনি তাঁর সমগ্র কর্মজীবন, সমগ্র সাধনা পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও মজলুম জনগণের সেবায় উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। যে প্রতিভাবান উজ্জ্বল তারকা দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল সমগ্র উপমহাদেশের রাজনৈতিক আকাশকে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন, তাঁর নশ্বর দেহ আজ আর আমাদের মধ্যে নেই; কিন্তু তিনি আমাদের জন্য যে কর্মপথ, নীতি ও আদর্শ রেখে গেছেন, তাঁর সে নীতি, আদর্শ ও কর্মপথ আমাদেরকে পরিচালিত করবে ভবিষ্যতের পথে আমাদের ভবিষ্যৎ সংগ্রামে। আমরা যদি তাঁর নির্দেশিত পথে এগিয়ে যেতে পারি তবে আমাদের কর্মের মধ্যে দিয়েই আমরা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব। সেটাই হবে নেতার প্রতি সবচেয়ে বেশি সম্মান দেখান, সেটাই হবে তাঁর সত্যিকারের স্মৃতি রক্ষা।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস আপনাদের সংগ্রামের ইতিহাস। সে ইতিহাসের সঙ্গে আপনাদের নতুন করে পরিচয় করানাের চেষ্টার কোন অর্থ হয় না। আপনারা জানেন, কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে এই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছিল। আপনারা জানেন, সৃষ্টি থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত কত রকম প্রতিকূল অবস্থা ও বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে আপনারা আওয়ামী লীগকে দেশের সেরা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গণতন্ত্রের মূলনীতি যেদেশ থেকে যখন তখন মুষ্টিমেয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন মহলের ইঙ্গিতে নির্বাসন দেওয়া হয়, যেদেশে কথায় কথায় বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা ও কর্মীবৃন্দকে জেলে আটক করা হয়, সেদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করা একটা বিরাট কাজ, একটা কঠোর কাজ। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে জনকল্যাণকর ও সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলা সম্ভব নয়। পরিতাপের বিষয়, আজ পর্যন্ত এর কোনটাই সম্ভব হয়নি। তার অর্থ এই নয় যে, আমরা আমাদের এতদিনের সংগ্রামে বিফল হয়েছি। উদাহরণস্বরূপ আমি আপনাদের সামনে মাত্র দু’একটি বিষয়ের অবতারণা করব। দেশ বিভাগের পর যখন দেশ একনায়কত্বের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল, যখন তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকারের সমালােচনা করলে “Opposition কাছের কুচাল দেয়েঙ্গে” বলা হতাে, তখন সর্বপ্রথম আমরা এদেশে বিরােধীদল সৃষ্টি করি। আমাদের প্রিয় নেতার সুষ্ঠু নেতৃত্ব, আর সংগঠনী ক্ষমতার ফলে আপনাদের দ্বারা এদেশে আওয়ামী লীগ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এদেশের আজ বহু রাজনৈতিক দল বিদ্যমান। আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিবিদ এবং জনসাধারণ সরকার ও সরকারী দলের সমালােচনা করছে এবং এ সমালােচনা করার যে তাদের অধিকার আছে এটা একটা স্বীকৃত বিষয় হলেও এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত করায় আপনাদের ও আপনাদের প্রতিষ্ঠানের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য, এ অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কত সংগ্রাম, কত ত্যাগ আপনাদেরকে করতে হয়েছে আপনাদের দুঃখ-দুর্দশা আর লাঞ্ছনার সে করুণ কাহিনী লেখা থাকবে পাকিস্তানের অতীত ইতিহাসের পাতায় পাতায়। আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করছি। আওয়ামী লীগই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার নেতা ও কর্মীবৃন্দ সর্বপ্রথমে দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্যের প্রতি কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে ও তার বাইরে দেশবাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ ও এখানকার দরিদ্র কৃষকের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাকে মুষ্টিমেয় শিল্পপতি ও ধনী সম্প্রদায়ের স্বার্থে পশ্চিমাঞ্চলে ব্যয় করা হয়ে আসছে, এবং বৈদেশিক ঋণ ও কেন্দ্র কর্তৃক অন্যান্য যাবতীয় ব্যয় যে প্রায় সবই পশ্চিমাঞ্চলে করে আসছে যার ফলে দুই অঞ্চলের মধ্যে বিরাট বৈষম্য ও ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে একথাও দেশবাসীকে সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ শুনিয়েছিল। এই সব কথা বলার জন্য আপনারা কত জেল-জুলুম ও অত্যাচার ভােগ করেছেন। কিন্তু আজ এসব অন্যায়ের প্রতিকার এমন জোরালাে গণদাবীতে পরিণত হয়েছে যে, পূর্ববর্তী সামরিক সরকার ও বর্তমান শাসন কর্তৃপক্ষও আজ বাধ্য হয়ে অন্ততঃ কাজে না হলেও মুখে আমাদের এসব অভিযােগের সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। অবশ্য এই বৈষম্যের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কোন দোষ নেই। এর পেছনে রয়েছে মুষ্টিমেয় সংশ্লিষ্ট স্বার্থপর মহল। যা হােক, এই বৈষম্য দূরীকরণের দাবীর স্বীকৃতিই আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সংগ্রামের সফলতার স্বীকৃতির সাক্ষ্য। আজ আমরা প্রায় দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর পরে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান আকারের এই সম্মেলনে মিলিত হচ্ছি। কেন এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আমরা আজ এখানে মিলিত হচ্ছি, কিভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হল এবং এই দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে কত সব ঘাতপ্রতিঘাত আমাদের নেতা ও কর্মীদের জীবন ও প্রতিষ্ঠানকে দুঃসহ যন্ত্রণা দিয়েছে, সে সম্বন্ধে দু’একটা কথা আপনাদের সামনে পেশ করছি। আপনারা জানেন, ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর হঠাৎ শাসনতন্ত্র নাকচ করে দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তন করা হােল । যে ইস্কান্দার মীর্জা রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসে ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনে ও তাদের কাজে অন্যায়ভাবে সর্বদা হস্তক্ষেপ করে দেশে স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে বাধা দিতেন, যার প্রভাবে দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র। প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, যিনি সব সময় অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে আজ একজনকে, কাল অপরজনকে প্রধান মন্ত্রিত্বের আসনে বসাতেন, সেই ইস্কান্দর মীর্জাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবের দোহাই এবং মরহুম শাহেদ আলী সাহেবের মৃত্যুর জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে দায়ী করে দেশের উপর সামরিক শাসন চাপিয়ে দেন। অথচ পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মরহুম লিয়াকত আলী খানকে প্রকাশ্য দিবালােকে মিলিটারী হেডকোয়ার্টার রাওয়ালপিণ্ডি শহরে হত্যা করার জন্য দেশে সামরিক শাসন জারি করা হল না, এমনকি হত্যাকারীকে অকুস্থলে পুলিশের লােক হত্যা করল, তারও কোন বিচার হল না। আর সামরিক শাসন জারির পর মীর্জা সাহেবের অন্যায় আচরণের পিছনে যে সব সামরিক অফিসার ছিলেন তাঁরা সামরিক শাসনজারির কয়েক দিনের ভিতরেই তাকে দেশ থেকে নির্বাসন দিতে বাধ্য হন। কারণ, মীর্জা সাহেব যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সিদ্ধহস্তের পরিচয় দিয়ে আসছিলেন, সেই হস্তক্ষেপ পরে এদের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হয়, এই ভয়ে এরা এই পথের কণ্টক অপসারণ করেন। এটা সর্বকাল ও যুগের নিয়ম যে, যে অন্যায় পথ কেউ অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে সেই অন্যায় পথেই সে নিজেও একদিন অপরের শিকারে পরিণত হবে। সামরিক শাসন জারি করার পরে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ একচেটিয়াভাবে রাজনৈতিক দলসমূহকে সবরকম দোষারােপ করতে লাগলেন এবং একথাও জোর গলায় প্রচার করতে লাগলেন যে, পাকিস্তানের ন্যায় অনগ্রসর দেশে রাজনৈতিক দলের কোন প্রয়ােজন নেই। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দকে নিরাপত্তা আইনে জেলে পুরা হল আর বহু সরকারী কর্মচারীকে স্ক্রীন আউট করে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল- এমনকি অনেক সরকারী কর্মচারীকে আটক করে জেলে নিয়ে যাওয়া হল। এখানেই এই শাসন কর্তৃপক্ষ ক্ষান্ত হলেন না। এবডাে ও পােড়া করে বহু নেতা ও কর্মীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হল, আমাদের অনেকের বিরুদ্ধে একের পর এক বহু মিথ্যা মামলা দায়ের করে সমগ্র সরকারী যন্ত্রের সকল প্রকার প্রভাব দ্বারা আমাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করার কত চেষ্টা হলতা আপনাদের ভালভাবেই মনে আছে। আল্লার রহমতে সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। শত চেষ্টা করেও বিচারে আমাদের কাউকে দোষী প্রমাণ করতে পারেনি।
অধিকার সচেতন জনগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে চায় না। তারা প্রবল বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তাদের দাবী নিয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং মাঝে মাঝে আন্দোলনের মারফত তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগলেন। তখন আবার একটি ফন্দি আঁটা হল শাসনতন্ত্রের নামে দেশকে আর একটা ধোকা দেওয়ার জন্য। আইয়ুব সরকার একটা শাসনতন্ত্র জারি করলেন তাঁরই সৃষ্ট শাসনতন্ত্র কমিশনের মতামতের বিরুদ্ধে। বর্তমানে প্রচলিত সেই শাসনতন্ত্রকে শাসনতন্ত্রের প্রহসন বই অন্য কিছু বলা চলে না, সেটা আপনারা ভালভাবেই জানেন। যে ভােটাধিকার প্রয়ােগ করে পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানরা পাকিস্তানের দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, যে ভােটাধিকার দ্বারা পাকিস্তান অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল, আমাদেরকে সে ভােটাধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মৌলিক গণতন্ত্রের নামে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ইউনিয়ন কাউন্সিলরকে দেশের একমাত্র ভােটাধিকার দিয়ে সমগ্র জাতিকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর বলা হয়েছে যে, জনসাধারণের এমন রাজনৈতিক শিক্ষা নেই যাতে তাদেরকে এই ভােটাধিকার দেওয়া চলে। সমগ্র জাতির পক্ষে এটা অত্যন্ত অবমাননাকর। যাদের ভােটে পাকিস্তান অর্জন সম্ভব হয়েছিল সরকারী কর্তৃপক্ষ তাদেরকে রাতারাতি অনুপযুক্ত নাগরিক বলে আখ্যা দিলেন। কারণ অত্যন্ত পরিষ্কার। জনসাধারণের হাতে এই অধিকার থাকলে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল আর দেশকে যেভাবে সেভাবে শােষণ ও শাসন করতে পারবে না। সে প্রমাণ তারা পেয়েছে ১৯৫৪ সনে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে। পূর্ণ মৌলিক অধিকার থেকেও দেশবাসীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান শাসনতন্ত্রে এমন সব ধারা সন্নিবেশিত আছে যাতে সমগ্র জাতিকে রাজনৈতিক পঙ্গুতে পরিণত করা হয়েছে। এমনকি, এক কলমের খোঁচায় তারা কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে ইসলামাবাদ নামক এক নতুন জায়গায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত করেছে এবং সে সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করছে। যে দেশের লােক বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করে চলেছে সে দেশে এত বিপুল ব্যয়ে রাজধানী স্থাপনের বিলাসিতা কেন? যে করাচীকে আমাদের এ অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকের কষ্টার্জিত অর্থে গড়া তােলা হয়েছে সে করাচীকেও তারা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছে। অবিচারের একটা সীমা আছে। কিন্তু আমাদের উপর যে অবিচার করা হচ্ছে তার নমুনা দুনিয়ার ইতিহাসে নেই। কাজেই, আমাদের সম্মুখে দীর্ঘ সগ্রামের প্রয়ােজন আছে। আপনাদের মনে আছে, এই গণবিরােধী শাসনতন্ত্র জারি করার পূর্বে গণআন্দোলনের ভয়ে স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল দেশের বহুসংখ্যক নেতা ও কর্মীকে জেলে আটক করেন। শুধু তাই নয়, যে মহান নেতার প্রচেষ্টা ও ত্যাগ ছাড়া পাকিস্তান হাসিল হওয়া সম্ভব হত না, পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে যার অবদান বর্তমানের সকল নেতৃবৃন্দের সম্মিলিত অবদানের চেয়েও ঢের বেশি, সেই দেশপ্রিয় জাতীয় নেতা জনাব সােহরাওয়ার্দীকেও তারা বিনা বিচারে জেলে নিয়ে যেতে এতটুকুও কুণ্ঠিত হয়নি। কে জানে, হয়ত বা এই নির্মম আঘাতই তাঁর মৃত্যুকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। সুখের বিষয়, আমরা অনেকে সেসময় কারারুদ্ধ থাকলেও দেশের ছাত্রসমাজ ও জনতা সরকারের এই অন্যায় আচরণকে ক্ষমা করতে পারেনি। তারা দেশে প্রবল আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিল। সমগ্র দুনিয়া জানে এ আন্দোলন কতখানি সফলতার সাথে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল। জনমতের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা নেই, তাদের এত বেশি কিছু আসে যায় না। এই সময় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের ভিত্তির সূত্রপাত হল- “নয় নেতার বিবৃতি”র মারফত। তারপর আমাদের নেতা সােহরাওয়ার্দী সাহেব ও আমরা একে একে জেল থেকে মুক্ত হই এবং দেশে সেই সময়ই গণসংযােগ সৃষ্টির জোরালাে আন্দোলন শুরু হয়। আমাদের নেতার নেতৃত্বে শাসনতন্ত্রকে গণতান্ত্রিক রূপদানের দাবীতে। কিন্তু কারাবাসে নেতার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গিয়েছিল। শীঘ্রই তিনি কঠিন হৃদরােগে আক্রান্ত হন। নেতার অনুপস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট কতখানি কাজ করতে পেরেছে সেটা আপনারা ভালভাবেই জানেন। অবশ্য গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ একথাও স্থির করেছিলেন যে, তারা কোন দল পুনরুজ্জীবিত না করেই শাসনতন্ত্রকে গণতন্ত্রীকরণের ভিত্তিতে কাজ করে যাবেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই কয়েকটি দলকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। তাছাড়া যে বিরাট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতার দ্বারা বিভিন্ন প্রােগ্রাম ও আদর্শের বিভিন্ন দলের লােকদের নিয়ে জাতীয় ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল সেই নেতা আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। তাছাড়া অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, একটি সংগঠিত সরকারী শক্তি, যার পিছনে রয়েছে দেশের সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, তার সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হতে হলে জাতীয় ফ্রন্ট বা প্লাটফরমের পেছনে ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আবশ্যক। বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে এ-কথা আমাদের অধিকাংশ নেতা ও কর্মী বহুদিন থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং এ দাবী জানিয়ে আসছিলেন।
আপনাদের মনে আছে, বিগত ১৯৬৩ সালের ৭ই এপ্রিল প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন জেলার প্রেসিডেন্ট, সম্পাদকবৃন্দ ও অন্যান্য নেতা ঢাকার বার লাইব্রেরী হলে এক সম্মেলনে মিলিত হন। এই সম্মেলনে অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে রায় দেন এবং আমাদের নেতা মরহুম সােহরাওয়ার্দীর আগমনের ও তাঁর সম্মতির অপেক্ষায় শেষ সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখেন। এ-কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, ঐ সম্মেলনে আমাদের সহকর্মী জনাব আতাউর রহমান খান তাঁর বক্তৃতায় দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেছিলেন যে, পার্টির অধিকাংশ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তিনি সে সিদ্ধান্ত অম্লান বদনে মেনে নেবেন। অবশ্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে দল পুনরুজ্জীবনের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। সর্বশেষে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এক মেনিফেস্টো বের করেছেন। এরূপ মেনিফেস্টো সুধু রাজনৈতিক দলের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব। এই মেনিফেস্টো প্রকাশের পর জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে আর ফ্রন্ট বলা চলে না। এরূপ মেনিফেস্টো শুধু রাজনৈতিক দলেরই পরিচায়ক। অথচ এই মেনিফেস্টো প্রকাশের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারীর বা অন্য কোন নেতার সঙ্গে কোনরূপ আলােচনা পর্যন্ত করা হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, এবং আমার বিশ্বাস, আপনারাও আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে, শুধু বিবৃতি ও প্রচার কার্যের দ্বারা প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতাসীনদের নিকট থেকে কোন দাবী আদায় করা সম্ভব নয়। আমরা সক্রিয় কর্মপন্থায় বিশ্বাসী। শুধু কতিপয় নেতার একতায় যে দেশের মুক্তি আসতে পারে এ নীতিতে বিশ্বাস করি না। গণদাবী আদায় করতে হলে শুধু কতিপয় নেতার তথাকথিত একতা নয়, জনগণের একতা সর্বাগ্রে প্রয়ােজন। আর সেই জনগণের একতা শুধু সক্রিয় ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের একতার মধ্য দিয়েই সম্ভব নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে। এই জন্যই পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্তের সময় এটাও আমরা স্থির করেছি যে, শাসনতন্ত্রকে গণতন্ত্রীকরণের জন্য সম্মিলিত পুনরুজ্জীবিত দলগুলি একত্রে একটা ফ্রন্টের মাধ্যমে সংগ্রাম করবে। আমরা আশা করি, আমাদের পুরাতন সহকর্মীরা শীঘ্রই আমাদের সাথে এসে যাবেন। শহীদ সাহেবের মৃত্যুতে যখন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আর কোন নেতাই বিভিন্ন আদর্শ ও প্রােগ্রামে বিশ্বাসী প্রতিষ্ঠানসমূহকে পরিচালিত ও নেতৃত্ব দিবার জন্য থাকল না, তখন দল পুনরুজ্জীবিত করার দাবীর বিরুদ্ধে আর কোন যুক্তিই থাকতে পারে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করা হল এবং সেখানে অন্যান্য পুনরুজ্জীবিত রাজনৈতিক দলের সাথে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যবৃন্দ ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এখানকার প্রাদেশিক আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আশা করি, আমাদের পুরাতন সহকর্মীরা পুনরায় আমাদের সাথে ফিরে আসবেন।
একটা কথা এখানে উল্লেখ না করে পারা যায় না যে, দীর্ঘ ১৬ বৎসরের পাকিস্তানের ইতিহাসে সব সময়ই দেখা গিয়েছে যে, যখন জনগণের কোন দাবী আদায়ের জন্য অগ্রসর হয়েছি, কেন্দ্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল আমাদের বিরুদ্ধে নানারকম কুৎসা রটনা করেছেন এবং আমাদের উপর নানারকম অত্যাচার করে আসছেন। এমনকি ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রিত্বের আসন থেকে যখন সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক ও অন্যায়ভাবে সরিয়ে দেওয়া হল তখনও আমরা নবগঠিত নূন সরকারকে কোনরকম ক্ষমতার অংশীদার না হয়েও সমর্থন জানাচ্ছিলাম শুধু একটি আশায় যে, ১৯৫৯ সনে। দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নূন সরকার তাদের কথা রেখে যখন সাধারণ নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি একের পর এক সম্পন্ন করছিলেন এবং সাধারণ নির্বাচন অনিবার্য এবং এই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ একদলীয় সরকার গঠনে সমর্থ হবে এবং সে অবস্থায় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল আর পূর্ব পাকিস্তানকে ও পশ্চিম পাকিস্তানে জনগণকে শােষণ করতে পারবে না, তখনই সেই মহল চরম আঘাত হানল সামরিক আইন জারির মারফতে। আর এর প্রথম ধাক্কা এল আমাদের প্রতিষ্ঠান, আমাদের নেতা ও কর্মীবৃন্দের। উপর। অত্যাচারের যে ষ্টিম রােলার চালান হল ভুক্তভােগী হিসেবে সেটা আপনারা ভালভাবেই জানেন। এই সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ, এমনকি আইয়ুব খান সাহেব স্বয়ং কত না কটাক্ষ করেছিলেন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইতিহাসের চাকা কারও অপেক্ষায় বন্ধ হয়ে থাকে না। আজ আইয়ুব খান সাহেব স্বয়ং একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের শুধু সভ্যই নহেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রধানও। একাধারে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আবার অন্য ধারে তিনি কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। শুধু তাই নয়, তিনি একথাও স্বীকার করেছেন যে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ব্যতীত দেশ শাসন ও সরকার পরিচালনা সম্ভবপর নহে। এ বিষয়ে তিনি যে ভিন্নমত পােষণ করতেন সেই ভুল এতদিনে নাকি তিনি বুঝতে পেরেছেন। তাই নাকি তিনি মুসলিম লীগে যােগদান করেছেন। চমৎকার!
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের অবতারণা করে আমি আমার রিপাের্ট শেষ করছি। সেটা হল এই যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ১৪/১৫ বৎসরের মধ্যে মাত্র দেড়বৎসরের জন্য আমরা কেন্দ্র ও পূর্ব পাকিস্তানে কোয়ালিশন সরকার গঠনে সমর্থ হয়েছিলাম। দেশের শােষিত জনসাধারণের জন্য এই অল্প সময়ে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তেমন কিছু করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য যে সময়ের প্রয়ােজন সে সময় আমরা পাইনি। কিন্তু যে অল্প সময় আমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলাম সেই সময়ে যে শুভ সূচনা করেছিলাম সেটা রেকর্ডের বিষয় বস্তু। আমরা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হিসাবে সকল রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিলাম এবং কাউকেই বিনা বিচারে আটক করা হবে না, এই নীতি গ্রহণ করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষে আমরা প্রায় ৭৬ কোটি টাকার চাউল বিদেশ থেকে আনিয়েছিলাম। এখানে আমরা ক্ষুদ্রশিল্প কর্পোরেশন, পাট কর্পোরেশন, ফিল্ম কর্পোরেশন, আভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থা প্রভৃতি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলাম। তাছাড়া ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রারম্ভিক সূচনা হিসাবে আমরা শিল্প ও বাণিজ্যিকে কেন্দ্র থেকে প্রদেশের হাতে এনেছিলাম। আমাদের বৈদেশিক নীতি ছিল “সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারও প্রতি কোন হিংসা নয়।” সামান্য দেড় বৎসরের মধ্যে শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে বিদেশে পাকিস্তানের মর্যাদা কি পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল সেটা আপনারা ভালভাবেই জানেন। আমরা একথা মােটেই দাবী করি না যে, আমরা দেশের জন্য বিরাট একটা কিছু করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমরা আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ করতে পেরেছিলাম যে, একদলীয় সরকার গঠন করতে পারলে সাধারণ নির্বাচনের পর আমরা নিশ্চয়ই সেদিকে সফল হতে পারতাম।
সর্বশেষে, আসুন, আজ এ শপথ গ্রহণ করি যে, যতদিন না পাকিস্তানের বুক থেকে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের পরাজয় ঘটবে, যতদিন না এদেশের গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে পারব, যতদিন না পাকিস্তানকে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হিসাবে গঠন করতে পারব, যতদিন না সমাজ থেকে শােষণের মূলােৎপাটন হবে, যতদিন না দেশের প্রত্যেক নাগরিক, দল, মত ও ধর্ম নির্বিশেষে অর্থনৈতিক মুক্তি ও আর্থিক প্রাচুর্যের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারবে, যতদিন না শ্রেণীবিশেষের অত্যাচার থেকে সমগ্র দেশ ও জাতিকে মুক্তি দেওয়া যাবেততদিন আমরা আমাদের নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশিত পথে সংগ্রাম চালিয়ে যাব। ন্যায় আমাদের ধর্মনীতি, আমাদের আদর্শ। জয় আমাদের অনিবার্য।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব